বইয়ের পৃষ্ঠা, বিষয়বস্তু ও মূল্য—তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত লঙ্ঘন করিয়া বেসরকারি প্রকাশকেরা উচ্চমাধ্যমিকের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) পাঠ্যবই প্রকাশ করিয়া চলিয়াছেন। উপরন্তু বইগুলি ভুলে ভরা। বেসরকারি প্রকাশকেরা শর্ত মানিয়া নির্ধারিত পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি জমা দিয়া অনুমোদন নেন। কিন্তু ইহার পরে কলেবর বাড়াইয়া বই ছাপান। কোনো কোনো বইয়ের পৃষ্ঠাসংখ্যা ফুলিয়া-ফাঁপিয়া আড়াই গুণের বেশি হইয়াছে। এইগুলি কোনোটিই অনুমোদনের সময় জমা দেওয়া পাণ্ডুলিপি নহে। শর্ত লঙ্ঘন করায় এই সকল বই কার্যত অনুমোদনহীন হইয়া পড়িয়াছে। আর কলেবর যত বাড়িয়াছে, বাড়িয়াছে বিক্রয়মূল্য, বিষয়বস্তু হইয়াছে কঠিনতর। শিক্ষার্থীদের নিকট ভুলে ভরা বইগুলি হইয়া উঠিয়াছে জটিল ও দুর্বোধ্য। বিশেষত মানবিক ও ব্যবসায় অনুষদের শিক্ষার্থীদের নিকট আইসিটি ভীতিকর বিষয়ে পরিণত হইয়াছে। শনিবার (১ ফেব্রুয়ারি) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক সম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।
সম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ছেলেমেয়েদের তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা প্রদানের জন্য সরকার ২০১৩ সালে আইসিটি বিষয়টি পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে। ইহা বাংলা-ইংরেজির মতো আবশ্যকীয় বিষয়। এনসিটিবি নিজে বইটি প্রকাশ করে না, তবে শর্তসাপেক্ষে বেসরকারি প্রকাশকদের মুদ্রণ ও বাজারজাতকরণের অনুমোদন প্রদান করে। বাজারে এখন এনসিটিবির অনুমোদনে ছাপাঙ্কিত ১৯টি বই চালু রহিয়াছে। এইগুলির মধ্য হইতেই কলেজগুলি যে কোনো একটি বাছিয়া লয়। শিক্ষাক্রম নির্ধারণ ও উন্নয়নের জন্য এনসিটিবি গঠিত দুইটি কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই ২০১২ সালে বর্তমান শিক্ষাক্রমটি তৈরি করা হয়। তবে কমিটির একাধিক সদস্যের দাবি, তাহাদের সুপারিশ উপেক্ষিত হইয়াছে। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে যেই সকল বিষয় পড়ানো হইতেছে, তাহা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্যায়ে পড়াইতেই হিমশিম খাইতে হয়। উপরন্তু আছে হাজারটা ভুলের জটাজাল। বইয়ের নির্দেশনামতো নির্দিষ্ট সফটওয়্যারে প্রোগ্রাম লিখিলে বাংলাদেশ শব্দটি ১০ বার দেখাইবার কথা, কিন্তু দেখানো হয় ১২ বার। কম্পিউটারে দুইটি সংখ্যার গরিষ্ঠ সাধারণ গুণনীয়ক (গ.সা.গু.) নির্ণয়ের প্রোগ্রাম লিখিলে ভুল ফল আসে। একটি বইয়ের প্রোগ্রামিং ভাষা অধ্যায়ের শিরোনামে বলা আছে, ইহা ১ হইতে ১০০ পর্যন্ত সংখ্যাগুলির যোগফল নির্ণয়ের প্রোগ্রাম। কিন্তু প্রোগ্রামটি চালাইলে যোগফলের বদলে আসিতেছে গুণফল। বাংলা, ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষার মতো আইসিটির বিষয়বস্তু হইল তথ্যপ্রযুক্তির ভাষা। ইহার আছে নিজস্ব ব্যাকরণ আর সংকেত বা কোড। প্রচলিত আইসিটি বইগুলিতে মোটাদাগে দুই ধরনের ভুল রহিয়াছে— চিহ্নের ভুল ও যুক্তির ভুল। ছাপার ভুল তো আছেই।
হাজারটা ভুল আর বিভ্রান্তিতে ভরা পাঠ্যবই পড়িয়া তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির (আইসিটি) ব্যাকরণ শিখিতেছে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। ভুলপাঠ শিখিয়াই তাহারা পরীক্ষা দিতেছে। প্রযুক্তিতে পিছাইয়া পড়া, ভুল আর বিভ্রান্তিতে ভরা এই বইগুলি পাঠদানের উপযুক্ত শিক্ষক থাকিলে শিক্ষার্থীরা তবু হয়তো রক্ষা পাইত; কিন্তু এই বিষয়ে অভিজ্ঞ শিক্ষকের অভাবও প্রকট। এই পরিস্থিতিতে, বত্সরের পর বত্সর বেসরকারি কিছু প্রকাশক শর্ত লঙ্ঘন করিয়া প্রতারণার আশ্রয় লইলেও তাহা বন্ধে শিক্ষা কর্তৃপক্ষের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নাই। তবে, এমন বিভ্রান্তির কথা মানিয়া নিয়াছেন তাহারা; আগামী শিক্ষাবর্ষ হইতে নিজে বই প্রকাশ করিবেন। তাহারা আশা করেন, তখন বিভ্রান্তি দূর হইবে। আমরাও সেই প্রত্যাশা করিব। সেই সঙ্গে ইহাও আশা করিব যে, প্রতারক ও দায়িত্বহীন এই সকল প্রকাশকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।