উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ দেশে সাধারণ নাগরিকের পড়াশোনার ধারা জীবন-জীবিকার প্রয়োজন মেটাতে সাহায্য করে। তবে জ্ঞানচর্চার বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায় না। পাঠক্রমগুলো এরকম যে, নির্দিষ্ট সময়ে শিক্ষাক্রম শেষ হয়।
পাঠক্রমের বিন্যাস এমন, অনেক কিছু সাধারণভাবে জানার অবকাশ থাকে, তবে সীমিত সময়ে গভীরভাবে চর্চার সুযোগ থাকে না। এসব দেশে সবাই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়তে আসে না। ইন্টারমিডিয়েট সমপর্যায় পর্যন্ত পড়ার পর রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ঠিক হয়ে যায় মেধা অনুযায়ী কে কোন ট্রেডকোর্স বা ডিপ্লোমা সম্পাদন করবে।
ভবিষ্যতে যারা নানা গবেষণায় যুক্ত থাকবে, তারাই চিন্তা করে উচ্চতর জ্ঞান অর্জনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। এছাড়াও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী গ্র্যাজুয়েট হওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকে। উন্নত দেশ হওয়ায় অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী তারা।
তাই নিজ দেশের মেধাবীদের পাশাপাশি নানা দেশের মেধাবীদের জায়গা করে দেয় বা বলা যায় আত্তীকরণ করে নেয়। এভাবে নিজেদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও বৈজ্ঞানিক উন্নয়নে এসব মেধা প্রয়োগ করে।
এ বাস্তবতায় আমাদের দেশের শিক্ষানীতি যদি উন্নত বিশ্বের কারিকুলামের অনুকরণে চলতে চায়, তবে হোঁচট খাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। কারণ দুই অঞ্চলের বাস্তবতা আলাদা। আমাদের দেশের সার্বিক উন্নয়নে মেধাবী জনশক্তির কর্মভূমিকা প্রয়োজন।
ফলে জ্ঞানচর্চাকে উপেক্ষা করে বাজার-অর্থনীতির চাহিদা পূরণের উপযোগী জনশক্তি উৎপাদন করলে উপরিকাঠামোর চাহিদা পূরণ হয়তো সম্ভব হবে কিন্তু ভিত্তিভূমি নড়বড়ে থেকে যাবে, যা কাম্য ভবিষ্যৎ নির্মাণ কঠিন করে তুলবে।
স্কুলশিক্ষা যেদিন অবজেকটিভ প্রশ্ন আর বৃত্ত ভরাটে আটকে গেল, তখন থেকে জ্ঞানচর্চার জায়গাটি উপেক্ষিত হতে থাকল। চূড়ান্ত সংকট তৈরি হল জিপিএ-৫ ইত্যাদির প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার পর। এ সংকটকে আরও শক্তিশালী করে ফেলল উচ্চাভিলাষী সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতির ভেতরে শিক্ষার্থীদের প্রবেশ করানোর পর থেকে।
এসব নিরীক্ষার বাইপ্রডাক্ট হিসেবে বাড়বাড়ন্ত হল কোচিং বাণিজ্য আর গাইড ব্যবসা। শিক্ষার্থী আটকে গেল কোচিংয়ের পরীক্ষা প্রস্তুতিতে। মুখস্থ করতে থাকল গাইডবই। শিক্ষা নিয়ে তো নিরীক্ষা কম করছেন না আমাদের সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষ। নানা বিতর্কের কারণে শিক্ষার্থীদের ওপরে চাপ কমানের জন্য নাকি অতি সম্প্রতি জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায় কিছুটা নম্বর কমানো হয়েছে।
নম্বর বিন্যাসেও কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। আমার মধ্যে এখনও সংশয় কাজ করছে। অর্থাৎ পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষায়ই আমরা আটকে রইলাম। বিষয়টি নিয়ে পরে একসময় আলোচনার ইচ্ছা রইল।
গত শতকের সত্তর ও আশির দশকেও এদেশে পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরি গড়ার প্রবণতা ছিল। বিকালে-সন্ধ্যায় স্কুল-কলেজে পড়া ছেলেমেয়েরা লাইব্রেরিতে এসে পড়াশোনা করত। বই ধার নিত। বন্ধুদের মধ্যে পড়ার একটি প্রতিযোগিতা ছিল। এখনকার প্রজন্মের কাছে এসব অচেনা হয়ে যাচ্ছে।
ভালো গ্রেড পাওয়ার জন্য শুধু শিক্ষার্থী নয়, অভিভাবকরাও ছুটছেন কোচিং সেন্টারগুলোয়। এভাবে শিশুশিক্ষার্থী পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য কোচিং, প্রাইভেট টিউশন, আর প্রশ্নব্যাংক তৈরিতে দিনমান কাটাতে লাগল আর হারিয়ে ফেলল শৈশব- আত্মবিকাশের নানা সোনালি পথ। সুকুমার রায় পড়া হল না। হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসনকে চেনা হল না। দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য জানার কৌতূহল তৈরি হল না। এমন এক কিশোর শিক্ষার্থীকে মননশীল বই পড়ায় ফিরিয়ে আনা কঠিন।
এ ধারায় বেড়ে ওঠা শিক্ষার্থী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেও পরীক্ষার প্রস্তুতিটাকেই জানল একান্ত আরাধ্য। শিক্ষার্থী হওয়ার পথ বন্ধ করে ওদের নিবিষ্ট পরীক্ষার্থী বানিয়ে ফেললাম। আমি কাছ থেকে দেখেছি এ ভুল শিক্ষানীতির কাঠামোতে বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েরা যখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন, তখন এদের অনেকেরই জ্ঞানচর্চার জায়গাটি সংকীর্ণ থাকে, যা স্বস্তি এবং অস্বস্তিতে ফেলে শিক্ষার্থীদের। স্বস্তি খুঁজে পায় সেই শিক্ষার্থীরা, যারা স্বল্প পুঁজিতে পরীক্ষার নদী পাড়ি দেয়ায় সরল পথ পেয়ে যায় শিক্ষকের কাছ থেকে। আর অস্বস্তিতে পড়ে স্বল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী, যারা কিছু জানার আগ্রহে উচ্চশিক্ষাঙ্গনে পা রেখেছিল।
আমি অতি সাম্প্রতিক সময়ের একটি উদাহরণ দিতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো এক বিভাগে সমন্বিত কোর্স হিসেবে প্রাচীন বিশ্বসভ্যতা পড়ানো হয়। এ কোর্সের চূড়ান্ত পরীক্ষায় আমি দ্বিতীয় পরীক্ষক ছিলাম। উত্তরপত্র মূল্যায়ন করতে গিয়ে হোঁচট খেলাম। প্রায় প্রতিটি উত্তরপত্রে অনেকটা একই লেখা। বিশেষ করে কতগুলো তথ্যগত ভুল প্রায় একই রয়েছে সব উত্তরপত্রে। এর মধ্যে বড় দাগে চোখে পড়ল সমাজতাত্ত্বিক হেনরি মর্গানের একটি তত্ত্ব একইভাবে উল্টে ফেলেছে সবাই।
আমি জানি সভ্যতার ইতিহাস নিয়ে বাংলা ভাষায় লেখা একটি বই বাজারে আছে যেখানে এ জাতীয় নানা ভুল রয়েছে। যে কারণে এ বইটি আমাদের বিভাগে পাঠ্য তালিকায় রাখা হয়নি। জানলাম সংশ্লিষ্ট শিক্ষক এই বইটিই পড়তে বলেছেন। সভ্যতার ইতিহাস পড়াতে তিনি স্বচ্ছন্দবোধ করতেন না বলে খুব কম ক্লাস নিয়েছেন এবং পরীক্ষার আগে একটি সাজেশন দিয়ে দিয়েছেন।
এভাবে শিক্ষার্থীরা একটি অস্বচ্ছ ধারণা নিয়ে পাঠ শেষ করছে। যার প্রতিফলন উত্তরপত্রে দেখতে পাচ্ছি। একটি নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন এমন অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে। সুতরাং বলা যায়, একটি ভুলনীতি ও পদ্ধতির মধ্য দিয়ে শিশুশিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে নিচ্ছি।