বিলাতে পড়াশোনারত এক তরুণ বাংলাদেশি গবেষক সালমান শওকত আমাকে তাঁর একটি লেখা পড়তে দিয়েছেন। তিনি জলবায়ু নিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য বিলাতে এসেছেন। কিন্তু আর্থ-সামাজিক সমস্যা নিয়েও লেখালেখি করেন। তিনি তাঁর প্রবন্ধটিতে লিখেছেন, বাংলাদেশে রাজনীতি এখন স্থবির কেন? জবাব, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে স্থবিরতা। প্রশ্ন, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে স্থবিরতা কেন? জবাব, সামাজিক চিন্তা-চেতনায় বন্ধ্যাত্ব।
আমি তাঁর লেখাটি আগ্রহের সঙ্গে পড়েছি। আমাদের সামাজিক অবক্ষয় ও পশ্চাত্গতি সম্পর্কে বহুকাল আগে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন হাসিনা সরকারের এককালের অর্থমন্ত্রী, বুদ্ধিজীবী বলে পরিচিত প্রয়াত শাহ মোহাম্মদ কিবরিয়া। তিনি নিজের সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘মৃদুভাষণে’ (বর্তমানে পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় না) নিজের কলামে তাঁর পাঠকদের এই বলে সতর্ক করেছিলেন যে, আমাদের অর্থনৈতিক তথা জাগতিক উন্নতি সত্ত্বেও সামাজিক অবক্ষয় ভয়াবহ। সামাজিক অবস্থান পশ্চাত্মুখী এবং সামাজিক মনন পচনশীল। এই অবক্ষয় অব্যাহত থাকলে আমাদের জাগতিক তথা অর্থনৈতিক উন্নতি দারুণভাবে ব্যাহত হবে, রাজনীতি কোনো নতুন ফসল ফলাবে না। রোববার (১৪ জুলাই) ইত্তেফাক পত্রিকার নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধনটি লিখেছেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী।
শাহ কিবরিয়ার সতর্কবাণীরই বিশ্লেষণ যেন পেয়েছি সালমান শওকতের সাম্প্রতিক গবেষণামূলক লেখায়। এখন বাংলাদেশের সমাজচিত্রে ভয়ংকর অবক্ষয় স্পষ্ট। আগের কোনো মূল্যবোধ বেঁচে নেই। নতুন কোনো মূল্যবোধ দেশ ও জাতি গ্রহণ করছে না। খবরের কাগজের পাতা ওল্টালে মনে হয় আমরা সুদূর অতীতের অন্ধকার যুগে ফিরে গেছি।
শিশু ও নারী নির্যাতন ভয়ংকরভাবে বেড়েছে। দুর্নীতি পাহাড়প্রমাণ। সামাজিক অবস্থা ও রাজনীতিতে সন্ত্রাস নিয়ামক শক্তি। ধর্ম এসেছিল মানবকল্যাণের জন্য। তা এখন সবচাইতে বড়ো ব্যবসা। বাংলাদেশে তো ব্যাংক, বিমা থেকে শুরু করে যাবতীয় ব্যবসায়ের পেছনে ‘ধর্মীয়’ ছাপ মারা হয়েছে, এই লেবেলের আড়ালে চলছে লোভ ও অতি মুনাফার খেলা। ছাত্রীধর্ষণ ও হত্যার ক্ষেত্রে মাদ্রাসা শিক্ষকদের একটি অংশই অগ্রগণ্য। তাদের হাতেই ধর্মের কীভাবে জঘন্য অবমাননা চলে, তার উদাহরণ এক মাদ্রাসা অধ্যক্ষ তার ছাত্রীকে ধর্ষণের পর তার হাতে কোরান তুলে দিয়ে শপথ করিয়েছেন, ছাত্রীটি এই ধর্ষণের কথা কখনো প্রকাশ করবে না।
যে কোনো দেশের আর্থসামাজিক উন্নতি এবং রাজনীতিতে আধুনিকতা ও প্রগতিশীলতার বিবর্তনমূলক অগ্রসরতা নির্ভর করে সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশ এবং তার গতিশীলতার ওপর। বলা হয়, ফরাসি দেশে সাম্য, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্বের আদর্শনির্ভর রুশো ও ভলতেয়ারের লেখনি ও সাংস্কৃতিক চেতনা ফরাসি বিপ্লব সম্ভব করেছিল। বহু প্রাচীন ও আধুনিক ইসলামি চিন্তাবিদ স্বীকার করেছেন, ‘জাহেলিয়াতের’ যুগে মক্কা-মদীনায় ইসলামের ইনসানিয়াত বা মানবতার বাণী প্রচারের অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করে গিয়েছিলেন, প্রাচীন আরবের ‘সাবআ মোয়াল্লাকার’ কবিগণ।
অবিভক্ত বাংলাও যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চেতনায় ভারতের অন্যান্য রাজ্যের চাইতে অনেক উন্নত ছিল এবং রাজনৈতিক চেতনা ও কার্যকলাপে ছিল অনেক অগ্রসর, তারও কারণ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বৈপ্লবিক ভূমিকা। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সৈয়দ আমির আলি, ওয়াজেদ আলীর মতো বহু সমাজ-সংস্কারক মনীষীর আবির্ভাব এবং তাদের সাংস্কৃতিক ও সমাজ সংস্কারমূলক আন্দোলন।
স্বদেশি থেকে স্বাধীনতার আন্দোলন পর্যন্ত সব রাজনৈতিক আন্দোলনের পেছনে ছিল প্রবল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রেরণা, যা সমাজকে নতুন চেতনার দিকে এগিয়ে দিয়েছে, ভেঙে আবার নতুনভাবে গড়েছে। কোনো অবক্ষয় সৃষ্টি হতে দেয়নি। বর্তমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের রাজনৈতিক আন্দোলনের সাফল্যের পেছনেও রয়েছে সাংস্কৃতিক তথা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের অবদান।
এই অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক আন্দোলন অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনা তৈরি করেছে। সমাজকে পশ্চাত্মুখী মানসিকতা থেকে মুক্ত করে উদার ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠন করেছে। রবীন্দ্রনাথ থেকে নজরুল, জসীমউদ্দীন থেকে জীবনানন্দ দাশ—এই অগ্রসরমাণ সমাজের সাংস্কৃতিক পিতা। আর এই সমাজে থেকেই যে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী রাজনীতি সমাজ ও দেশকে সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে দিয়েছে, তার পিতৃ-চরিত্র হলেন, চিত্তরঞ্জন, সুভাষ চন্দ্র, ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৪৭ সালের বাংলাভাগের পরও বাঙালির অখণ্ড সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদী শক্তিশালী চেতনার ধারাটি বহন করেছেন বাম-গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতারা। দেশে রাজনীতি ভাগ হয়েছে, কিন্তু তাঁরা অসাম্প্রদায়িক জাতিগঠনের সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে ভাগ হতে দেননি।
ভাষার আন্দোলন, বাংলা হরফ রক্ষার আন্দোলন, রবীন্দ্রসংগীত রক্ষা, বৈশাখী-নবান্ন উত্সব রক্ষা, শরত্ উত্সব রক্ষা, যাত্রা, জারি সারি, বাউলগীতি রক্ষা প্রভৃতি সাংস্কৃতিক জাগরণের আন্দোলন অসাম্প্রদায়িক জাতিচেতনা তৈরি করেছে। বাঙালির অসাম্প্রদায়িক নেশন হুড ও নেশন স্টেট তৈরি করেছে, যার নেতৃত্ব দিয়েছেন এই জাতীয়তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান।
দেশ ও জাতিকে খণ্ডিত করার পাকিস্তানি রাজনীতি বাংলাদেশকে ভাগ করতে পেরেছে, কিন্তু তার অখণ্ড জাতিসত্তাকে ভাগ করতে পারেনি। জাতিকে বিভক্ত করে আদর্শ ও মূল্যবোধবর্জিত সমাজে অনাচার, ব্যভিচার, সর্বনাশা অবক্ষয়ের সূচনা করতে পারেনি। সামাজিক মূল্যবোধের পাহারাদার বুদ্ধিজীবী তথা সুশীল সমাজকে অর্থ ও সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন পথভ্রষ্ট করতে পারেনি অতীতে।
সুশীল সমাজকে কিনে ফেলা, সমাজকে বিভ্রান্তি ও বিভক্ত করা, সামাজিক ও স্বাধীনতার আদর্শ ও মূল্যবোধগুলো ধ্বংস করা সম্ভব হয় স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছর পর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় নেতাদের হত্যার পর। দেশে যে ‘মিলিটারি অ্যান্ড মস্ক অক্সিম’ ক্ষমতা দখল করে তাদের আশ্রয়ে অতীতের সাম্প্রদায়িকতা উগ্র এবং হিংস্র মৌলবাদের চেহারা ধারণ করে এবং আঠারো শতকের কালাপাহাড়ের মতো বাঙালির অখণ্ড ও সেক্যুলার কালচারাল নেশন হুডের সব ভিত্তিগুলো ভাঙতে শুরু করে।
আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার দীর্ঘ সংগ্রামের ফলে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে হিংস্র মৌলবাদের ভূত তাড়ানো সম্ভব হয়েছে বটে, কিন্তু তাদের সৃষ্ট সামাজিক অবক্ষয়ের স্রোত এখনো বন্ধ করা যায়নি। আইন করে এই অবক্ষয় দূর করা যাবে না। তার জন্য সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা জরুরিভাবে আবশ্যক। আর এই সামাজিক প্রতিরোধের চেতনা সমাজে তৈরি করতে হলে শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ সাংস্কৃতিক আন্দোলন আগে গড়ে তোলা দরকার। এই আন্দোলনই কেবল বিভ্রান্ত জাতিকে জাগাতে পারে। রাজনৈতিক আন্দোলন বা সরকারি আইন তা একা পারবে না।
সামাজিক অবক্ষয় অনেক সময় এত শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে, তা সর্ষের ভেতর ভূত ঢোকার মতো অবক্ষয়-প্রতিরোধের দুর্গেও অনুপ্রবেশ করে। বাংলাদেশেও এই ভূত অনুপ্রবেশ করেছে শুধু সুশীল সমাজের মধ্যে নয়, ক্ষমতাসীন দলের মধ্যেও। এবার বাংলাদেশ ঘুরে এসে আমার মনে হয় আমাদের সমাজ সংস্কৃতিতে এখন মুম্বাইয়া অপসংস্কৃতির দারুণ প্রভাব। কেবল রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও আইন দ্বারা এই ভূত তাড়ানো যাবে না। দরকার হবে বাম গণতান্ত্রিক চেতনার ওপর দাঁড় করানো শক্তিশালী ও সংঘবদ্ধ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের। সেই আন্দোলন খণ্ড-বিখণ্ডভাবে দেশে যে নেই তা নয়, কিন্তু দরকার অখণ্ড ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের। তা এখন কোথায়?