মতপ্রকাশ বন্ধেই যত তৎপরতা - দৈনিকশিক্ষা

মতপ্রকাশ বন্ধেই যত তৎপরতা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

সুকুমার রায় ‘একুশে আইন’ ছড়ায় লিখেছিলেন, ‘চলতে গিয়ে কেউ যদি চায়/ এদিক ওদিক ডাইনে বাঁয়,/ রাজার কাছে খবর ছোটে,/ পল্টনেরা লাফিয়ে ওঠে।’ বাংলাদেশে এখন এই পল্টনের ভূমিকায় নেমেছে ছাত্রলীগ। ‘রাজার কাছে তথ্য’ যাওয়ার আগেই বিচার করা শেষ। এখন ‘এদিক-ওদিক চাওয়া মানেই’ মৃত্যু। শুক্রবার (১১ অক্টোবর) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন শওকত হোসেন।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যেমন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ কিছু প্রশ্ন তুলেছিলেন। দেশের স্বার্থরক্ষার বিষয়ে নিজের মতামত জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে কিছু কথা লিখেছিলেন। এর পরিণতি হচ্ছে পিটিয়ে হত্যা। বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে মুক্তচিন্তা চর্চার বড় জায়গা, অথচ মতপ্রকাশের জন্য সেখানেই তাঁকে খুন হতে হয়েছে সহপাঠীদের হাতে।

আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ডে সারা দেশ স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে। বিক্ষুব্ধ দেশের সাধারণ মানুষ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে চলছে নানা কর্মসূচি। এর মধ্যেই এখনো চলছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করার কাজটিও।

বুয়েটে দীর্ঘদিন ধরে চলা নির্যাতন নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু তাও বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। এমনকি মতপ্রকাশের দায়ে সরকারি দলের এক নেতার বিরুদ্ধেও নেওয়া হয়েছে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা।

অর্থ ও স্বার্থ

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ফেসবুকে একটি প্রশ্ন তুলেছেন। জানতে চেয়েছেন, দেশের স্বার্থরক্ষার নানা বিষয়ে ভিন্নমত পোষণের অভিযোগে কাউকে হত্যা দূরের কথা, যেকোনোভাবে হেনস্তা করা যায়—এ ধারণা দলীয় ছাত্রনেতাদের মাথায় কী করে ঢুকল?’

দেশে সব সময়ই নিরঙ্কুশ ক্ষমতা থাকে ক্ষমতাসীন দলের। ‘উইনার্স টেক অল’ নীতিতেই দেশ চলে। ফলে সবাই এসে ভিড় করে ক্ষমতাসীন দলে। আবার ক্ষমতা যদি অর্থ নিয়ে আসে, তাহলে তো ভিড় বাড়ে বহুগুণ। যে কোনোভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকাটাই হয়ে পড়ে সবার একমাত্র লক্ষ্য। ফলে যেকোনো আন্দোলন, যেকোনো জমায়েত, যেকোনো মতপ্রকাশেই তাদের ভয়। অতএব এসব করা যাবে না। আর এই বার্তার কারণেই হয়তো বুয়েটের ছাত্রলীগ নেতারা পিটিয়ে হত্যা করেছেন আবরারকে।

অর্থনীতিবিদ সেলিম জাহান ফেসবুকে লিখেছেন, ‘স্বার্থ ও অর্থ যেখানে মুখ্য, সেখানে মানুষ আত্মকেন্দ্রিক হবেই। অতিকেন্দ্রিকতা কতগুলো মাত্রিকতার সৃষ্টি করে; যেমন যেকোনো ব্যাপারে চরম অবস্থান নেওয়া, সহনশীলতা হারিয়ে ফেলা, পরমতসহিষ্ণুতার বিলুপ্তি। এ অবস্থায় কোনো রকম দ্বিমতের অবস্থান স্বীকার করা হয় না। “তুমি আমার থেকে যেকোনো দিকেই ভিন্ন হলে, তুমি আমার কাছে শুধুমাত্র অগ্রহণযোগ্যই নও, তুমি আমার কাছে পরিত্যাজ্য”—এটাই আজ আমাদের সামাজিক সম্পর্কের একটা মূলসূত্র।’

কথা বলা যাবে না

ভিন্নমতের কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ জানাতে বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের শিক্ষার্থীরা একটি ওয়েবপেজ চালু করেছিলেন। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) গত বুধবার এক চিঠিতে ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ) এবং ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারীদের (আইএসপি) এই ওয়েবপেজ বন্ধের নির্দেশ দেয়। তারপরই অভিযোগ জানানোর সুযোগটি বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত দুই শতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছিল।

টুটুল চৌধুরী নামের একজন বেসরকারি চাকরিজীবী ফেসবুকে লিখেছেন, অত্যাচার বন্ধ না করা গেলেও ওয়েবসাইট বন্ধ করা গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বুয়েটের একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘এই পেজে আগেও শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন। সমস্যা স্বীকার করে নিলে সমাধানের পথ প্রশস্ত হয়। সেটা না করে এটিকে সমস্যা ধামাচাপা দেওয়ার একটি চেষ্টা বলেই মনে করি।’ বুয়েটের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, পেজটা বন্ধ করে দেওয়া ঠিক হলো না। অনেক শিক্ষার্থীই মুখ খুলতে শুরু করেছিলেন। পেজটা বন্ধ করে সেই সুযোগ কেড়ে নেওয়া হলো। আরেকজন শিক্ষার্থী বলেন, যদি সত্যিই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা থাকে, তাহলে বিটিআরসি একটা হট নম্বর বা পেজ চালু করতে পারত, যেখানে শিক্ষার্থীরা তাঁদের কথা বলতে পারবেন।

আরেকজন শিক্ষার্থী বলেন, আবরারকে মরতে হয়েছিল মতপ্রকাশের কারণে। ওই ওয়েবপেজে ঢুকে শিক্ষার্থীরা তাঁদের ওপর ঘটে যাওয়া নির্যাতনের কথা বলছিলেন। পেজটি বন্ধ করে দিয়ে সেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতাটাই কেড়ে নেওয়া হলো।

তবে নির্যাতনের কথা জানাতে নতুন একটি পেজ খুলেছেন বুয়েটের শিক্ষার্থীরা। নতুন পেজের ঠিকানাটি হলো

কথা বন্ধ দলের মধ্যেও

স্বাধীন মতপ্রকাশের চর্চা নেই দেশের রাজনৈতিক দলের মধ্যেও। তবে দলের সমালোচনা নয়, দেশের স্বার্থ নিয়ে কথা বলেছিলেন খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ বাহারুল আলম। আবরার ফাহাদের মতো তিনিও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পাদিত সাম্প্রতিক চুক্তির সমালোচনা করেছিলেন। আর এই অপরাধে গত বুধবার তাঁকেও দল থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। স্থায়ীভাবে কেন বহিষ্কার করা হবে না, সাত দিনের মধ্যে এর কারণ দর্শাতেও বলা হয়েছে।

খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ফরিদ আহমেদ গণমাধ্যমে যে বার্তা পাঠিয়েছেন সেখানে বলা হয়েছে, ৯ অক্টোবর সন্ধ্যায় খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে এক জরুরি সভা হয়। সভায় দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গ, সরকারপ্রধান, দলীয় প্রধান ও রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য ফেসবুকে প্রদান করায় শেখ বাহারুল আলমকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে।

তবে বাহারুল আলম বলেন, ‘আমি এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো কাগজ বা চিঠি পাইনি। তবে দল সম্পর্কে কোনো কথাই আমি লিখিনি। যেটুকু লিখেছি তা হলো, ভারত যে সব বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থকে অগ্রাহ্য করছে, সেটা আমি আমার একান্ত ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে সমালোচনা করেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনে করি, নাগরিক হিসেবে, আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি আমার দেশের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রাখতে চাইব। আওয়ামী লীগের একজন কর্মী-সমর্থক হিসেবে আমি আমেরিকা, মিয়ানমার বা ভারতের সমালোচনা করতে পারব না?’

তলানিতে বাংলাদেশ

২০১৩ খ্রিষ্টাব্দ সরকার একটি তথ্যপ্রযুক্তি আইন করেছিল। সেই আইনের ৫৭ ধারায় ভিন্নমত প্রকাশের জন্য নাগরিকদের গ্রেপ্তার ও হয়রানির অভিযোগ করে আসছিলেন গণমাধ্যম ও মানবাধিকারকর্মীরা। সমালোচনার মুখে এর পরিবর্তে সাইবার অপরাধ দমনে নতুন একটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হয়। সেই আইনেও ৪টি ধারায় ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে ৫৭ ধারাকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।

ফলাফল হচ্ছে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে বৈশ্বিক নানা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে। গত বুধবার বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) বৈশ্বিক সক্ষমতা সূচক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গণমাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪১টি দেশের মধ্যে ১২৩তম। আবার রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গণমাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫০তম।

ফেসবুকে অর্থনীতিবিদ সেলিম জাহানের লেখার শেষ অংশটাই আসলে শেষ কথা। তিনি লিখেছেন, ‘গণতন্ত্রের একটি মূল স্তম্ভই হচ্ছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। সেই মতপ্রকাশে মানুষ যদি ভীত হয়ে পড়ে, তাহলে গণতন্ত্র হারিয়ে যাবে। সে জায়গাটিকে আমরা যাতে ধ্বংস না করি।

হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036439895629883