শিক্ষা প্রশাসনে এক নতুন ঘটনার জন্ম দিয়েছেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের চলতি দায়িত্বে থাকা বি সি এস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত সরকারি কলেজ শিক্ষক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন।
চলতি দায়িত্ব পাওয়ার তিন বছর ১ মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পর এমন নজিরবিহীন ঘটনার জন্ম দিলেন ফাহিমা খাতুন। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ জানুয়ারি ৪৯৫ জন সিনিয়রকে ডিঙ্গিয়ে তিন মাসের জন্য মহাপরিচালকের চলতি দায়িত্ব পেলেও অদ্যাবধি বহাল রয়েছেন। আর চলতি বছরের ৩ জুলাই অবসরত্তোর ছুটিতে যাওয়ার প্রক্কালে এ ঘটনা ঘটালেন নিজের যোগ্যতার চেয়ে তিন ধাপ উপরের পদ ‘মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক’ পদে থাকা মূলত: সরকারি কলেজের সমাজবিজ্ঞানের এই শিক্ষক।
গতকাল ১০ ফেব্রুয়ারি মহাপরিচালকের একক সিদ্ধান্তে মাউশির সহকারী পরিচালক (কলেজ-২) মো. আনোয়ার হোসেনকে সহকারী পরিচালক (কলেজ-৪) এর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে মাউশি অধিদপ্তরেরই সহকারী পরিচালক (কলেজ-৪) মো. হাবিবুর রহমানকে সহকারী পরিচলক (কলেজ-২) এর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আদেশের ৫ মিনিটের মধ্যেই তা বাস্তবায়ন হয়।
জানা যায়, আনোয়ারের বিরুদ্ধে অধ্যাপক ও অধক্ষরা বেয়াদবির অভিযোগ আনেন কয়েক ডজনবার। মাধ্যমিকের পরিচালক অধ্যাপক এলিয়াছের মতোই আনোয়ার কী যে বোঝেন না তা-ই বোঝেন না। ফলাফল সরকারের কোষাগার খালি অথবা ক্যাডার সদস্যদের ভোগান্তি। আনোয়ারের ‘বেয়াদবির’ খবর কেঁদে কেঁদে দৈনিকশিক্ষাশিক্ষাকে জানিয়েছেন সরকারি কলেজের কয়েকজন অধ্যক্ষ ও অধ্যাপক। আর হাবিবের বিরুদ্ধেে সরকারি কলেজ শিক্ষকদের এসিআর জালিয়াতি করে টাকা কামানোর অভিযোগ এন্তার। এমপিওতেও শেষ খাওয়া খেয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা দৈনিকশিক্ষাডটকমকে নিশ্চিত করেন যে, গত বছর মহাপরিচালক মন্ত্রীর দপ্তরে তদবির করে আনোয়ারকে কলেজ-২ পদে এবং হাবিবকে কলেজ-৪ পদে বদলিভিত্তিক নিয়োগের আদেশ জারি করান। এতে সহায়তা করেন শাহজাহান নামের মন্ত্রণালয়ের একজন যার বিরুদ্ধে ঢাকা কলেজে ছাত্রশিবিরের রাজনীতি করা অভিযোগ রয়েছে। তবে, ওই আদেশ জারির পর মহাপরিচালকের ‘গোয়েবলস বাহিনী’ যথারীতি এই মর্মে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়েছিলেন যে, তৎকালীন শিক্ষাসচিব তার নিজ পছন্দে আনোয়ার ও হাবিবকে পদায়ন দিয়েছেন।
তবে, স্মরণকালের ইতিহাসের সেরা শিক্ষা সংস্কারক ও শিক্ষাসচিব মো. নজরুল ইসলাম খান দৈনিকশিক্ষাডটকমকে নিশ্চিত করেন যে, মাউশি মহাপরিচালকের পছন্দে এবং মন্ত্রীর লিখিত নির্দেশেই আনোয়ার ও হাবিবকে মাউশিতে পদায়ন আদেশ জারি করার ব্যবস্থা করেছেন তিনি। সাবেক শিক্ষাসচিব ব্যক্তিগতভাবে চাননি নানা কারণে বিতর্কিত আনোয়ার বা হাবিবকে মাউশিতে রাখতে। সচিব হয়ে তিনি মন্ত্রীর নির্দেশ মেনেছেন মাত্র।
তবে, মন্ত্রণালয়ের সেই নির্দেশ উল্টালেন মাউশি মহাপরিচালক ফাহিমা খাতুন। এর আগে কেউ কখনোই মাউশিতে এমন ঘটনা ঘটাননি বলে কেউ কেউ দাবী করেছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন এর আগে একবার ঘটেছিল তবে তার জন্য খেসারত দিতে হয় ম্যালা।
এক প্রশ্নের জবাবে মাউশির সদ্য সাবেক দুইজন মহাপরিচালক দৈনিকশিক্ষাকে বলেন, একথা ঠিক যে মন্ত্রণালয় যেভাবে লিখিত নির্দেশ দেন যে অমুককে সহকারি পরিচালক তমুককে পরিচালক কলেজ ও প্রশাসন পদে বদলিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হলো, তা-ও বিধি সম্মত নয়।
উদাহরণ হিসেবে বলেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যখন কোনও অতিরিক্ত সচিব বা যুগ্ম-সচিব বা উপ-সচিবকে কোনও মন্ত্রণালয়ে পদায়ন দেন তখন উল্লেখ করে দেন না যে অমুককে উপ-সচিব কলেজ বা মাধ্যমিক হিসেবে আদেশ দেওয়া হলো। ডেস্ক ডিস্ট্রিবিউশনটা স্ব স্ব মন্ত্রণালয়ের সচিবের এখতিয়ার। ঠিক তেমনি কে কোন পরিচালক বা উপ-পরিচালক বা সহকারি পরিচালকের পদ পাবেন সেই সিদ্ধান্ত নেবেন মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। সেই হিসেবে মহাপরিচালক কোনও ভুল বা অন্যায় করেননি বলে মনে করেন মাউশির সাবেক এই দুই মহাপরিচালক। সংবাদের মতামতে তারা নাম প্রকাশ করতে না চাওয়ার কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘পেশায় সিনিয়র এবং অবসরে থাকার পরও বর্তমান মহাপরিচালক ও তাদের গোয়েবলস বাহিনী তাদেরকে অপমানসূচক কথা ও খবরদারি করায় তারা ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ। তাই তারা দৈনিকশিক্ষাকে অনুরোধ করেছেন তাদের মতামত প্রকাশ হলেও যেন নাম প্রকাশ না হয়।’
দীর্ঘদিন যাবত মন্ত্রণালয় যেভাবে বদলিভিত্তিক পদায়ন আদেশ দিয়ে আসছেন তা ঠিক চর্চা নয় মনে করেন সাবেক এই মহাপরিচালকেরা। সেই হিসেবে বিদায়ী মহাপরিচালক হয়তো কোনও শুভকর্মের সূচনা করে গেলেন! সাহসী কাজ করে গেলেন!
তবে, অপর এক সাবেক মহাপরিচালক বলেন, এহেন সংস্কারক বা শুভ কাজ মহাপরিচালক হিসেবে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ জানুয়ারিতে যোগ দেওয়ার পরদিন থেকেই করতে পারার সাহস দেখাতে পারলে ক্যাডারের প্রকৃত মর্যাদা রক্ষা হত। শেষবেলায় এসব করে পরবর্তী মহাপরিচালকদের বিপদ বাড়িয়ে দিয়ে গেলেন না তো তিনি? এমন প্রশ্ন করেন ওই সাহসী সাবেক মহাপরিচালক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘ইদানিং মহাপরিচালক মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে শিক্ষা সচিবের ঠিক পাশের চেয়ারটিতে বসে পড়ছেন। আর অনুগত গোয়েবলস বাহিনী প্রচার করেন যে মহাপরিচালক পদটি এক নং গ্রেডের তাই ওভাবে বসা’। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের প্রশ্ন পদটি এক নম্বরের হলেও বর্তমানে ওই পদে যিনি আসীন তার তো যথাযথ যোগ্যতা নেই এবং অর্জন করারও আর সুযোগ বা সময়ও নেই। তাই সচিবের পাশের চেয়ারে বসে পড়াটা ছেলেমানুষি! এই জমানায়, আগে তো নিয়ম ঠিক করতে হবে তারপর তা বাস্তবায়নের জন্য লড়াই করতে হবে। চোখের জল নয় মগজের লড়াই করতে হবে। আবার বিএনপি-জামাত ঘেষাঁ নেত্রী অ্ধ্যাপক নাছরিনের নেতৃত্বে দেড়শতাধিক শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা নিয়ে নজিরবিহীনভাবে বিএনপিনেত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক অফিসে গিয়ে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে রাতের আধাঁরে সভাও বন্ধ করতে হবে। বিএনপি ক্ষমতায় আসলে মহাপরিচালক হওয়ার ধান্দায় শিক্ষকের বা ক্যাডার পরিচয় ভুলুণ্ঠিত করে নিন্মমানের রাজনীতিকদের পদাঙ্ক অনুসরণ করলেও শোকজ করা হয়নি নাছরিন গংদের। কারণ ওই সময়টা ছিল এমন যে, কদিন পরেই বিএনপি-জামাত ক্ষমতায় আসছে আর শুধুই তরিকুলের শ্যালি হওয়ার কারণে মাউশি মহাপরিচালকের পদঠি ভ্যানিটি ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলা হচ্ছে।
শিক্ষা বিষয়ক একমাত্র মৌলিক গবেষণা ও সংবাদ মাধ্যমের প্রতিষ্ঠান দৈনিকশিক্ষার গবেষণায় দেখা যায়, সামরিক স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান সরকারি কলেজ শিক্ষকদের নামমাত্র শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত করেছেন। সেই থেকে তারা না প্রশাসন ক্যাডার বা অন্যান্য ক্যাডারের মতো সব সুযোগ সুবিধা পান না আগের ন্যায় উন্নত স্কেলে বেতন-ভাতা পান। মর্যাদার সঙ্গে শিক্ষকতাও করতে পারছেন না বলে মনে করেন সিনিয়ররা। জিয়ার ওই হঠকারী ও শিক্ষাঘাতী সিদ্ধান্তের আগে সরকারি কলেজ শিক্ষকরা ছিলেন মর্যাদাবান শিক্ষক, কোনওভাবেই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নন। আর এখন হয়েছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের কর্মচারী এবং যাদের বিরুদ্ধে ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের গণকর্মচারী আইনে শাস্তি ও বিভাগীয় ব্যবস্থা হয়। ক্যাডারভুক্তির আগে সরকারি কলেজ শিক্ষকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের চেয়ে বেশি বেতন পেতেন। তাই প্রবীণ অধ্যাপকরা চান নামমাত্র এই ক্যাডার পরিচয় বাদ দিয়ে মহান শিক্ষকতায় ফিরে যাওয়া এবং স্বতন্ত্র বেতন স্কেল আদায়।
শিক্ষকদের ললাটে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী তকমাটা যেন আর না থাকে। বর্তমানে প্রায় সবাই ক্যাডার পরিচয় দিতে পছন্দ করলেও তারা সবাই সরকারি কলেজ বা মাদ্রাসার শিক্ষক। পৃথিবীর সভ্য দেশের ইতিহাসে শিক্ষকদের সুযোগ সুবিধা আর মান মর্যাদা নিয়ে এমন তামাশা আর কোনো দেশে আছে বলে এখনও জানা যায়নি।
দৈনিকশিক্ষার বিশ বছর মেয়াদী গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষা ক্যাডারর শতকরা ৯৯ জন ‘বাইচান্স’ শিক্ষক, ‘বাইচয়েস’ শিক্ষক নন। সহজ কথায় বাধ্য হয়েই শিক্ষা ক্যাডার আর তাই শিক্ষক, বি সি এস এর লিখিত পরীক্ষায় আর একটু কম নম্বর পেলেই ডাক অথবা তথ্য ক্যাডার জুটতো। শতকরা ১ ভাগ বাদে বাকী সবাই মেধার লড়াইয়ে হেরে যাওয়ায় পররাষ্ট্র, পুলিশ, প্রশাসন বা ট্যাক্স ক্যাডার পাননি। বাধ্য হয়েই ৭ বা ৮ নম্বর পছন্দের শিক্ষা ক্যাডারে যোগ দিয়েছেন। আবার যারা সরকারি শিক্ষক হতে পারেননি তারাই বেসরকারি শিক্ষক হয়েছেন।
অবশ্য নটরডেম, হলিক্রসের মতো হাতেগোণা দুএকটি ব্যতিক্রম রয়েছে। আবার কয়েক হাজার রয়েছেন যারা বেসরকারি কলেজেই ছিলেন কিন্তু সরকারগুলোর সস্তা জনপ্রিয়তা আর ভোটবাণিজ্য ঠিক রাখতে হঠাৎ ঘোষণা দিয়ে জাতীয়করণ করেছেন। বদলি হয়ে ঢাকা কলেজে এসে কলেজের নাম-ডাক ধূলায় মিশিয়ে দিয়েছেন। তারাও রাতারাতি শিক্ষা ক্যাডার বনে গেছেন বিভাগীয় পরীক্ষা ছাড়াই। এটাও শিক্ষাঘাতী সিদ্ধান্ত।
ফলে উচ্চমাধ্যমিক লেভেলে সরকারি কলেজগুলোর পড়াশোনার মান নেমে গেছে। বেসরকারি কলেজগুলো ভালো করছে। আর সম্মান শ্রেণিতে একক পরীক্ষক পদ্ধতি হওয়ায় এখন আর সম্মান শ্রেণিতেও পড়ানোর দরকার হয় না। কেউ শিক্ষাথী নেই সবাই এখন পরীক্ষার্থী।
তবে, শিক্ষা ক্যডারে যোগ দিয়ে কেউ কেউ আদর্শ শিক্ষক হওয়ার চেষ্টা করে সফল হয়েছেন আবার কেউ কেউ সামনে প্রশাসন ক্যাডারকে তোয়াজ করছেন কিন্তু পেছনে চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে উদ্দেশ্য হাসিল করেছেন। আবার সাংবাদিকদের কাছে ধর্ণা দিচ্ছেন এই বলে যে প্রশাসন ক্যাডার তাদেরকে কোনঠাসা করে রেখেছে বা তাদের পদগুলো আকড়ে রেখেছেন। সুতরাং লেখালেখি করে সহায়তা করতে হবে। আবার কেউ কেউ ক্যাডার পরিচয় দিয়ে অফিস আদালতে চাকরি করে ঘুষ-মুষ দিয়ে উপ-সচিব বনে গিয়ে ‘কাক ময়ুরের পগার লাগিয়ে ময়ুর সাজার মতো অবস্থায় পতিত হয়ে শেষ জীবনে হাপিত্যেস করছেন’।
দৈনিকশিক্ষার গবেষণায় দেখা যায়, বাইচান্স শিক্ষা ক্যাডারে যোগ দিয়েই মরিয়া হয়ে পড়াশোনা করে অধিকাংশ কেটে পড়ছেন প্রশাসন বা পুলিশ বা অন্য ক্যাডার পেয়ে। ক্যডার বদলানোর গত ২০ বছরের এমন অনুমতির তালিকা দৈনিকশিক্ষার হাতে রয়েছে।
আবার অন্য ক্যাডার থেকে উপ-সচিব হওয়ার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ১০ জনের নাম চাইলেও তদবিরবাজি আর টাকাকড়ি দিয়ে ৬৭ জনের নাম পাঠিয়ে দিচ্ছেন। কার নাম পাঠাবেন তা নিয়েও কোনও নীতিমালা তৈরি করতে পারেনি শিক্ষা অধিদপ্তরের মেধাবী ও চৌকস মহাপরিচালক, পরিচালক ও উপ-পরিচালকরা। এখানেও অনিয়ম আর স্বজনপ্রীতি চলছে বছরের পর বছর। অনিয়মের তথ্য প্রমাণ দৈনিকশিক্ষার হাতে রয়েছে।
৩১৬ টি সরকারি কলেজ ও মাদ্রাসায় ১৬ হাজারের বেশি শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।