মর্যাদা দিতে হবে টেকসই উন্নয়নের মুখ্য রূপকারদের - Dainikshiksha

মর্যাদা দিতে হবে টেকসই উন্নয়নের মুখ্য রূপকারদের

ড. এম এ মাননান |

প্রতিটি জাতিরই উন্নয়নের একটি প্রাণভোমরা থাকে। জাতি ভিন্ন হলেও প্রাণভোমরার রূপ এক, পরিচয় এক, শুধু ভাষার কারণে নাম ভিন্ন। আর এ প্রাণভোমরাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এনে দেয় জাতির সর্বাঙ্গীণ উন্নয়ন। জাতি হয় সজীব, সবল আর প্রাণজোয়ারে উদ্ভাসিত। তাঁদের হাতেই তৈরি হয় সক্ষম মানুষ, দক্ষ কর্মী, চৌকস নেতা, স্বাপ্নিক পরিকল্পনাবিদ-পলিসি প্রণেতা, নিপুণ ব্যবস্থাপক, নিবেদিত স্ট্র্যাটেজিস্ট ও সফল বাস্তবায়নকারী। নিশ্চিত হয় জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়ন। এ প্রাণভোমরা হলো একটি জাতির শিক্ষকসমাজ। সমৃদ্ধ শিক্ষকসমাজই সব পর্যায়ে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করে, শিখনফল অর্জনে জাতির ভবিষ্যৎ কাণ্ডারিদের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে, মূল্যবোধ আর নৈতিকতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের কারিগর হিসেবে কাজ করে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রয়োজনগুলো পূরণ করে আর তৈরি করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের জন্য এক স্বপ্নময় পৃথিবী।

শিক্ষকসমাজের এই অতুলনীয় অবদানের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ১৯৯৪ সালের ৫ অক্টোবর থেকে ইউনেসকোর অনুপ্রেরণায় পালিত হয়ে আসছে আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবস (বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবেও পরিচিত)। ১৯৯৬ সালের ৫ অক্টোবর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে বিভিন্ন দেশের সরকারি প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত ‘শিক্ষকদের মর্যাদা’ শীর্ষক সম্মলনে গৃহীত এবং ইউনেসকো ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন (আইএলও) কর্তৃক স্বাক্ষরিত সুপারিশমালায়ও শিক্ষক দিবস পালনের জন্য ৫ অক্টোবর তারিখটি নির্ধারিত হয়। এই দিনটি শিক্ষকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের দিন, তাঁদের অবদানকে স্মরণ করার দিন, তাঁদের মর্যাদাকে স্মৃতির অতলান্তে হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচানোর দিন। জাতিসংঘ স্বীকৃত ১৯৩টি দেশের মধ্যে শতাধিক দেশ বিশ্ব শিক্ষক দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালন করে আসছে। কোনো কোনো দেশ এ দিবসে বিশেষ পোস্টাল স্টাম্প ইস্যু করে দিবসটির মর্যাদাকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে, যেমনটি করেছিল কানাডা সরকার ২০০২ সালে সামষ্টিকভাবে স্কুল শিক্ষকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার লক্ষ্যে।

শিক্ষাদানের পেশাকে (টিচিং প্রফেশনকে) সঠিক মর্যাদায় সমাসীন করা আর এর গুরুত্ব অনুধাবনে সহায়তার লক্ষ্যে এবং শিক্ষাদান ও দেশের উন্নয়নে শিক্ষকদের অবদানকে স্মরণের নিমিত্ত আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে দিবসটি পালন করা হয়। কোনো কোনো দেশ জাতীয় শিক্ষক দিবসের সঙ্গে মিল রেখে আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবসের আয়োজন করে। কোনো কোনো দেশ ভিন্ন তারিখে ভিন্ন নামেও দিবসটি পালন করে থাকে। যেমন—যুক্তরাষ্ট্রে বলা হয় ‘শিক্ষক প্রশংসা দিবস’ (টিচারস অ্যাপ্রিসিয়েশন ডে)। এটি পালন করা হয় মে মাসের প্রথম সপ্তাহের মঙ্গলবার। আরব মুলুকের ১১টি দেশ ফেব্রুয়ারিতে পালন করে এ দিবসটি।

এ বছর আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হলো ‘শিক্ষার অধিকার মানে কোয়ালিফাইড শিক্ষকদের অধিকার।’ এ স্লোগান দিয়ে গ্লোবাল কমিউনিটিকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে শিক্ষকদের অধিকার নিশ্চিত না করা হলে শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত হবে না। ২০১৮ সালেও আমরা দেখতে পাচ্ছি দুনিয়াভর কোয়ালিফাইড শিক্ষকের অনেক অভাব। প্রায় ২৬৪ মিলিয়ন শিশু আর কিশোরের অবস্থান শিক্ষাজগতের বাইরে। ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্য অর্জন করার জন্য প্রয়োজন ৬৯ মিলিয়ন নতুন শিক্ষক। শিক্ষকের এই চাহিদা পূরণ করতে হলে সচেতনতা বাড়াতে হবে সর্বমহলে—বিশ্বব্যাপী। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলার বিষয়টিকে হেলাফেলা করে দেখার সুযোগ নেই। উজ্জ্বল করতে হবে এই মহান পেশাকে, সর্বদিক থেকে সম্মানে, ক্ষমতায়নে, প্রণোদনায়, স্মরণে আর প্রশংসায়—শুধু এই দিনেই নয়, বছরের প্রতিটি দিনে।

বাংলাদেশে শিক্ষকদের মর্যাদা কতটা সমুন্নত আজ? ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে দেখা যাক। সরকারের কিছু পদক্ষেপ শিক্ষকদের মর্যাদায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শিক্ষাবান্ধব প্রধানমন্ত্রী আর শিক্ষামন্ত্রীর সরাসরি উদ্যোগে শিক্ষকদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দ্বিগুণ করা হয়েছে, পদমর্যাদায় পরিবর্তন করা হয়েছে এবং ক্রমান্বয়ে প্রতিষ্ঠান সরকারীকরণের মাধ্যমে অবকাঠামোগত ও পরিবেশগত পরিবর্তনের মাধ্যমে শিক্ষকদের ক্ষমতায়নের পথে বাধার অচলায়তন সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। মঞ্জুরি কমিশনের নেতৃত্বে ‘হেকেপ’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকদের জন্য অর্থবহ গবেষণা করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে; জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে ‘কলেজ শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প’র মাধ্যমে কলেজ পর্যায়ের শিক্ষকদের জন্য দেশি-বিদেশি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে; হেকেপ-পরবর্তী ‘হিট’ প্রকল্পের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মান বৃদ্ধির প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। তবে আত্মতুষ্টিতে ভোগার সময় আসতে আরো বহু সময়ের প্রয়োজন। সিস্টেম লেভেলে যেসব উদ্যমী এসব উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলেই শুধু ভবিষ্যতে আমরা হয়তো দেখতে পাব একটি সমৃদ্ধ শিক্ষকসমাজ, যারা গড়ে তুলবে উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা।

দাবি করার আগেই দাবিযোগ্য বিষয়গুলোকে আমলে নেওয়া হলে সেটি হবে শিক্ষকদের কাছে অনেক মর্যাদার। শিক্ষকদের কেন রাস্তায় নামতে হবে কোনো কিছু পাওয়ার জন্য? কেন ঘুরতে হবে ঘরে ঘরে, এজন-সেজনের দুয়ারে দুয়ারে? কেন দূর-দূরান্ত থেকে রাজধানীতে এসে ধরনা দিতে হবে কর্মকর্তাদের কার্যালয়ে? আশা করছি, অচিরেই বেসরকারি শিক্ষকরা পাবেন ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট আর বৈশাখী ভাতা। যোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলো হবে এমপিওভুক্ত। কর্তাব্যক্তিদের ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না যে সমৃদ্ধ জাতি গঠন করতে হলে আর ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জন করতে হলে শিক্ষকসমাজের বঞ্চনা কমাতেই হবে। মর্যাদা আর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতেই হবে। মর্যাদা প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকদের মানোন্নয়ন করতে পারলেই নিশ্চিত হতে পারে শিক্ষার সার্বিক গুণগত মান। সর্বোপরি তৈরি করতে হবে গুণী শিক্ষকদের শিক্ষা-পরিবারের সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত পৌঁছার জন্য সুস্পষ্ট ‘ক্যারিয়ার পাথ’।

একজন শিক্ষক হয়ে সহকর্মী শিক্ষকদের কাছে জানতে চাই, উন্নয়নের মহাসড়কে চলার অগ্রযাত্রাকে বহমান রাখার জন্য যে রকম মানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়া দরকার, তা দেওয়ার জন্য আমরা কি সঠিক ভূমিকা রাখছি? নিম্নগামী মানকে ঊর্ধ্বমুখী করার জন্য আমরা কি পদক্ষেপ নিচ্ছি? আমরা কি ক্লাসে ঠিকমতো যাচ্ছি? শিক্ষাদানে আমরা কতটুকু আন্তরিক? প্রাথমিকে নাকি ৪৬ শতাংশ শিক্ষার্থী ঠিকমতো বই পড়তে পারে না; এ দায় কি আমরা এড়াতে পারি? আমরা কেন শিক্ষার্থীদের মুখস্থনির্ভর আর পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষার দিকে প্রতিনিয়ত ঠেলে দিচ্ছি? শিক্ষার্থীদের বিশ্লেষণক্ষমতা সৃষ্টি এবং বৃদ্ধির জন্য আমরা কি যথাযথ উদ্যোগ নিচ্ছি? পাঠ্য বইয়ের গুণমানে কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হলেও আমরা শিক্ষকরা কি পাঠদানের পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে পাঠ্য বইকে শিক্ষার্থীদের কাছে সহজবোধ্য আর হৃদয়গ্রাহী করে তোলার চেষ্টা করছি? প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তো সরকার ভৌত অবকাঠামোর ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আমরা কি তাতেই সন্তুষ্ট থাকব? জাতির ভবিষ্যৎ কাণ্ডারিদের তৈরির জন্য আমরা কয়জন শিক্ষা-প্রযুক্তি আত্মস্থ করে তা শিক্ষাদানে কাজে লাগানোর জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি? আমাদের গরজ আছে কি আদৌ ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বর্তমানের ভিত্তিকে মজবুত করার? আসুন, শিক্ষকদের স্মরণ করার আজকের এই দিনটিতে প্রতিজ্ঞা করি, আমরা শিক্ষকরা আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে সাধ্যমতো পালন করব এবং আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিকভাবে গড়ে তোলার সর্বাত্মক চেষ্টা করব।

 

লেখক : উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

 

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ ও ‘বিশ্ব বই দিবস’ - dainik shiksha স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ ও ‘বিশ্ব বই দিবস’ শিক্ষার মান পতনে ডক্টরেট লেখা বন্ধ জার্মান পাসপোর্টে - dainik shiksha শিক্ষার মান পতনে ডক্টরেট লেখা বন্ধ জার্মান পাসপোর্টে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0042550563812256