মা-বাবা ও শিক্ষকের প্যারেন্টিং দক্ষতা জরুরি - দৈনিকশিক্ষা

মা-বাবা ও শিক্ষকের প্যারেন্টিং দক্ষতা জরুরি

মাছুম বিল্লাহ |

মা-বাবা ও শিক্ষকদের প্যারেন্টিং বা লালন-পালন দক্ষতা থাকা প্রয়োজন কেন? প্যারেন্টিং হচ্ছে শিশুর আবেগকে বোঝা, সে বয়স অনুযায়ী সঠিক আবেগ প্রকাশ করছে কি না, সঠিক আবেগ নিয়ে বড় হচ্ছে কি না, তাদের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ তৈরি হচ্ছে কি না সে বিষয়গুলো দেখা। চিন্তাশীল ও সচেতন মা-বাবা ও শিক্ষকরা  যেকোনো সিদ্ধান্তই নেন না কেন, তার সব কিছুই তাঁদের সন্তানদের এবং শিক্ষার্থীদের কল্যাণের জন্য নিয়ে থাকেন। হ্যাঁ, তাঁরা সব ক্ষেত্রে যে পারফেক্ট হবেন এমন নয়, কোনো প্যারেন্টসই কিংবা কোনো শিক্ষকই পুরোপুরি পারফেক্ট নন, কোনো শিশুও পারফেক্ট নয়। এ বিষয়গুলো চিন্তা করেই টার্গেট ও আকাঙ্ক্ষা সেট করতে হবে। মা-বাবা হিসেবে নিজেদের জন্য প্রথম, তারপর সন্তানদের জন্য উচ্চমান নির্ধারণ করতে হবে। শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও একই কথা। মনে রাখতে হবে, আমরা তাদের জন্য ‘রোল মডেল’ বা ‘অনুকরণীয়’ নমুনা।

মা কিংবা বাবা হিসেবে আমরা আমাদের ভালো অনুভূতিগুলো সন্তানদের সঙ্গে শেয়ার করব, আলোচনা করব; তাতে তাদের মধ্যে আনন্দের অনুভূতি জাগ্রত হবে। সেটি তারা অন্যের সঙ্গেও শেয়ার করবে। তাদের না-বোধক কোনো অনুভূতির কথা না  জানানোই ভালো, তাতে তাদের পজিটিভ উন্নয়ন ঘটতে সমস্যা হয়। যেসব ছেলে-মেয়ের মা-বাবা সরাসরি লালন-পালন করেন এবং তাদের সব কিছুতে সময়মতো সাড়া দেন, তারা সুষম আবেগীয় উন্নয়ন, সামাজিক উন্নয়ন ও মানসিক  ভারসাম্য নিয়ে বেড়ে ওঠে। শিশুদের সঙ্গে কথা বলতে হবে, তাদের কথা শুনতে হবে যত্নের সঙ্গে। এভাবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করলে তারা যেকোনো সমস্যায় মা-বাবার কাছে আসবে, তাঁদের সঙ্গে শেয়ার করবে।

একটি কথা মনে রাখতে হবে যে একজন  শিশুকে কিংবা শিশু শিক্ষার্থীকে তার মা-বাবা, তার পরই তার শিক্ষক ভালোভাবে চেনেন। অন্য কেউ তার  জীবন সম্পর্কে  জানে না। আমরা আমাদের সন্তানদের  সঙ্গে কেমন আচরণ করব, কেন করব তা বাইরের কেউ বুঝবে না। শিশুদের সঙ্গে যথাসম্ভব সময় নিয়ে কথা বলতে হবে, যাতে তাদের  বোধগম্যতা জানা যায়, তাদের সম্পর্কে বেশি বেশি তথ্য সংগ্রহ করা যায়। ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে মৌখিক ভাষার পরিবর্তে মুখমণ্ডলের প্রকাশ, দেহভঙ্গিই বেশি প্রয়োজন, তাতে তাদের চিন্তাভাবনা, অনুভূতি সম্পর্কে জানা যায়। শিশুরা মা-বাবার সঙ্গে সময় কাটাতে চায়। এটি তাদের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

শিশু যখন ঘুমায়, খাবার  খায় কিংবা  খেলা করে তখন তাদের নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তারা কোন কাজগুলো পছন্দ করে, কোনগুলো করে না, কোনটিতে বেশি আগ্রহ দেখায়, কোনটিতে বিরক্ত হয়, কোনটিতে প্রতিক্রিয়া দেখায়, পরিবর্তনের সঙ্গে সে কেমন আচরণ করে, পরিবেশের সঙ্গে সে কতটুকু খাপ খাওয়াতে পারছে, অথবা সময় নিচ্ছে, কিভাবে খাপ খাওয়াচ্ছে—এ বিষয়গুলো মা-বাবা ও শিক্ষক গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জানতে পারেন। এগুলো শিশুর চরিত্রের স্বাভাবিক দিক, কোনো শিশুই  এ থেকে ভিন্ন নয়। মা-বাবা ও শিক্ষক যখন এগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন তখন তাঁরা তাঁদের শিশুদের সম্পর্কে আরো বেশি বেশি জানতে পারেন এবং সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

সঠিক পর্যবেক্ষণের অভাবে মা-বাবা যখন তাঁদের সন্তানদের চিনতে পারেন না অর্থাৎ তাদের চরিত্র সম্পর্কে জানতে পারেন না, তখন তাঁরা তাঁদের সন্তানদের সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করেন। ভুলভাবে বিচার করেন। অতএব, শিশুদের মনোবিজ্ঞান মা-বাবাকে বুঝতে হবে, জানতে হবে; কারণ শিশু বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়ার সময় মা-বাবা ভুল সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। লালন-পালন করা বা শিশুর যত্ন নেওয়া মানে শিশুকে শুধু আরাম দেওয়া বোঝায় না। বাবা কিংবা মা হিসেবে নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে—(ক) আমার সন্তান কী করতে সবচেয়ে ভালোবাসে, কী করতে পছন্দ করে? (খ) তার অপছন্দের কিছু তাকে করতে হলে সে বিষয়টি কিভাবে দেখে, কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখায়? সবজি হয়তো তার পছন্দ নয়, অথচ তার শারীরিক মঙ্গলের জন্য তাকে তা খেতে দেওয়া হচ্ছে, সেটি সে কিভাবে খাচ্ছে? তাড়াতাড়ি ঘুমানো তার অভ্যাস নয়, অথচ মা-বাবা তাকে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে বলেছেন, ব্যাপারটি সে কিভাবে নিচ্ছে? (গ) সে কতটা সামাজিক? তার আবেগ-অনুভূতি কি সে অন্যের সঙ্গে শেয়ার করে, প্রকাশ করে, না লুকায়? নতুন কিছু করার চেষ্টা করে? (ঘ) তার পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে পরিচিত হতে বা নিজেকে পরিচিত করাতে সে কতটা সময় নেয়? সে কি নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছে? মাঝে মাঝে আপনার সন্তানের বয়সী অন্য শিশুদের অবজার্ভ করুন, যা অপানার সন্তানকে আরো বেশি বুঝতে সহায়তা করবে। আপনার সন্তান সামাজিক পরিবেশে কিভাবে তার আচরণ প্রদর্শন করে, আর অন্য একটি  শিশু সেটি কিভাবে  করছে তা ভালোভাবে লক্ষ করুন। তার সক্ষমতা ও দুর্বলতা আপনাকে বুঝতে সহায়তা করবে। তবে তুলনা করা বা বিচার করা অর্থে দেখা ঠিক হবে না। আপনার সন্তানের আবেগকে কখনোই অবমূল্যায়ন করবেন না। তার সক্ষমতাকে অবমূল্যায়ন করবেন না। তারা এক বিশেষ মেজাজ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তারা কেউ হয়তো দ্রুত কাজ করতে পারে, দ্রুত কথা বলে, মুখের ওপর কথা বলে; কেউ বা তার বিপরীত। কেউ ধীরস্থির এবং লাজুক প্রকৃতির।

শিশুর আচরণ নির্ভর করে সে যে পরিবেশে বড় হয়, বাস করে, কাদের সঙ্গে মেলামেশা করে এগুলোর ওপর এবং তার চারপাশের মানুষের ওপর। শিশু কোন কারণে অক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে কিংবা সামাজিক সঙ্গ থেকে নিজেকে দূরে রেখেছে— এ বিষয়গুলো তার সঙ্গে কথা বলে, তাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে কারণ বের করে ফেলতে হবে। কারণ এগুলো অনেক বড় কোনো সমস্যার জন্ম দিতে পারে। আপনি যে আপনার সন্তানের কথা শুনছেন শুধু তা নয়, তাদের বুঝতে দিতে হবে যে আপনি তাদের কথা মনোযোগসহকারে শুনছেন এবং বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নিচ্ছেন। তাদের কোনো প্রশ্নের উত্তরে আপনি ভালোভাবে সাড়া দিন।

শিশুরা তাদের মতামত ও ধারণা বিভিন্নভাবে প্রকাশ করে। তারা কথায় প্রকাশ করা ছাড়াও বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে তাদের প্রকাশ করে। যদি দেখেন আপনার সন্তান কিংবা শিক্ষার্থী  ছবি আঁকতে কিংবা লিখতে কিংবা অভিনয় করতে পছন্দ করে, তাহলে তাকে তা করতে উৎসাহিত করুন। তাদের কল্পনার জগৎ প্রসারিত করার জন্য আপনিও তার পছন্দের সঙ্গে মিল রেখে বিষয় নির্বাচন করে দিতে পারেন।

আপনার সন্তানের সম্পর্কে অনুমান করে সব সময় কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া ঠিক হবে না। আপনার সন্তান যদি কোনো কমপ্লেইন না করে, অভিযোগ না করে আপনি হয়তো অনুমান করছেন যে আপনার সন্তান খুবই আনন্দিত, খুশি ও তৃপ্ত। আপনি হয়তো গর্বও বোধ করেন তার এ রকম আচরণে। আপনি অনুমান করে নিয়েছেন যে আপনার সন্তান ভদ্র, লক্ষ্মী। সে ভদ্র বলে কারো সামনে কিছু বলে না, কোনো অভিযোগ করে না। কোনো ধরনের উল্টাপাল্টা বা ভয়ংকর আচরণ করে না। আপনার এই অনুমান আপনার সন্তানকে সঠিকভাবে জানার দরজা বন্ধ করে দিতে পারে।

সব শেষে আমাদের মনে রাখতে হবে যে শিশুকে ভালোবাসার মতো এত সুন্দর বিষয় আর কিছুই নেই শিশুশিক্ষায়। বাসায় সন্তানের সঙ্গে দেখা হলে, কথা বলা শুরু করলে তাকে দোষারোপ করা, কোনো কিছুর সমালোচনা করা, দোষ খুঁজে বেড়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে; কারণ এতে শিশু তার আত্মসম্মানবোধের হানি মনে করে। একই বিষয় শ্রেণিকক্ষ ও বিদ্যালয়েও প্রযোজ্য। শিশুদের বা শিক্ষার্থীদের দোষ না খুঁজে কোথায় তাদের উৎসাহ প্রদান করা যায় সেসব ক্ষেত্র খুঁজতে হবে। শিশুদের জন্য মা-বাবা ও শিক্ষকের ভালোবাসা এবং  অনুভূতি সব সময়ই তাদের আচরণ ও কার্যাবলিকে ধনাত্মকভাবে প্রভাবিত করে।

লেখক : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত সাবেক ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজ শিক্ষক

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0075321197509766