পঞ্চগড়ে এবার দুটি মাদরাসার নাম শোনা যাচ্ছে, যেগুলো রূপকথার গল্পকেও হার মানিয়ে দিয়েছে। সদর উপজেলায় প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত মাদরাসার নাম জালিয়াতি করে নতুন দুটি মাদরাসা গড়ে উঠেছে। একটি চক্র দুটি মাদরাসার নামসহ কাগজপত্র জালিয়াতি করে জাতীয়করণের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করছে। এরই মধ্যে নিয়োগের নামে প্রায় ৩০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
এই জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়েনি প্রশাসনের চোখেও। একটি টিনশেড ঘর তুলে স্থানীয় প্রশাসন, শিক্ষা দপ্তর ও বোর্ড থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত দৌড়ঝাঁপ করছে চক্রটি। প্রশাসন শিক্ষা ও নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগে স্বতন্ত্র এবতেদায়ি মাদরাসার যে তালিকা পাঠিয়েছে, তার শুরুতে রয়েছে এই মাদরাসা দুটি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সদর উপজেলার ডুবানুচী গ্রামে ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ডুবানুচী বরকতিয়া স্বতন্ত্র এবতেদায়ি মাদরাসা। ২০১৮ সালে একই নাম দিয়ে মাদরাসা গড়ে ওঠে ২০ কিলোমিটার দূরে খারুয়া গ্রামে।
এদিকে সদরের শুরিভিটা গ্রামে ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় শুরিভিটা হাসনায়নীয়া নজিরিয়া স্বতন্ত্র এবতেদায়ি মাদরাসা। ২০০১ সালে নাম পাল্টে হয় শুরিভিটা দাখিল মাদরাসা। ২০১৯ সালে ‘শুরিভিটা হাসনায়নীয়া নজিরিয়া স্বতন্ত্র এবতেদায়ি মাদরাসা’ স্থাপন করা হয় প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে বন্দেরপাড়া গ্রামে।
স্থানীয়রা জানায়, বিতর্ক এড়ানোর জন্য কোনো নামফলক স্থাপন করা হয়নি। নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরাও জানেন না কোথা থেকে দেওয়া হলো এমন নাম। মাদরাসা দুটির পক্ষে যেসব কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়েছে তা জাল। জমি রেজিস্ট্রির দলিলও জাল। মাদরাসা দুটির প্রতিষ্ঠা দেখানো হয়েছে ১৯৬৫ সাল। পুরনো পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জাল করে দেওয়া হয়েছে শিক্ষক নিয়োগ। প্রতিটি শিক্ষকের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা। এ ছাড়া মাধ্যমিক শিক্ষা দপ্তরে কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ব্যানবেইসে ভুয়া তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে। ছয়টি আধাপাকা কক্ষসংবলিত ভবনের কথা উল্লেখ করা হলেও বাস্তবে একটি তিন কক্ষের টিনশেড ও টিনের বেড়ার ঘর ছাড়া কিছু দেখা যায়নি। শিক্ষার্থীদের যে তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে সেটিও শুধু কাগজে-কলমে। কোনো কাগজপত্র যাচাই না করেই উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম প্রামানিক ও সাবেক জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হিমাংশু কুমার রায় সিংহ ব্যানবেইসে তথ্য পাঠানোর কাগজে স্বাক্ষর করেছেন। ভুয়া কাগজপত্রের ওপর ভর করেই এগিয়ে যাচ্ছে প্রতারকচক্র।
ডুবানুচী বরকতিয়া স্বতন্ত্র এবতেদায়ি মাদরাসা ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ফজল হক জানান, জয়নুল নামে এক ব্যক্তি মাদরাসা দুটি স্থাপনে সহযোগিতা করছেন। তাঁর এক ছেলেকে সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকরি দেওয়া হয়েছে।
শুরিভিটা হাসনায়নীয়া নজিরিয়া স্বতন্ত্র এবতেদায়ি মাদরাসার প্রধান শিক্ষক ফজল হকের আরেক ছেলে মিজানুর রহমান। মাদরাসার সামনের জমিতে চাষ করা হচ্ছে।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নুরে আলম বলেন, ‘খারুয়া গ্রামের ফজল ও বন্দেরপাড়ার মিজানুর মাদরাসা দুটি চালু করেছেন।’
কামাতকাজলদীঘি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোজাহার আলী বলেন, ‘১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠার যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, তা মিথ্যা।’
নতুন প্রতিষ্ঠিত ডুবানুচী বরকতিয়া স্বতন্ত্র এবতেদায়ি মাদরাসার প্রধান শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘মাদরাসাটি অনেক আগে প্রতিষ্ঠিত। তবে গত বছর থেকে এবতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে আমাদের শিক্ষার্থীরা।’
শুরিভিটা হাসনায়নীয়া নজিরিয়া স্বতন্ত্র এবতেদায়ি মাদরাসার প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমান বলেন, ‘শুরি নামে এক লোক ছিলেন, তাঁর নামে এই মাদরাসা হয়েছে।’ ডুবানুচী বরকতিয়া দাখিল মাদরাসার সুপার আজিজুর রহমান বলেন, ‘নাম জালিয়াতি করে কিভাবে তারা মাদরাসা স্থাপন করতে পারে, আমাদের মাথায় আসে না।’
শুরিভিটা দাখিল মাদরাসার সুপার মো. সাইফুল্লাহ বলেন, ‘এত বড় জালিয়াতি করল, কেউ বিষয়টি টের পেল না। এটিই বড় আশ্চর্যের বিষয়।’
পঞ্চগড় সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোসলেম উদ্দিন বলেন, ‘এসব বিষয় দেখে মাধ্যমিক শিক্ষা দপ্তর। আমরা শুধু উপবৃত্তি ও পরীক্ষার বিষয়টি দেখি।’
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম প্রামানিক বলেন, ‘মাদরাসাগুলোর কাগজপত্র পেলে তা যাচাই করে দেখা হবে।’
পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আব্দুল মান্নান বলেন, ‘কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগে যে তালিকা পাঠানো হয়েছে তা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে পাঠানো হয়েছে।’