পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি শিশুদের জন্য মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক চালুর চার বছরেও পুরোদমে ক্লাসে তা কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না। অপরিচিত বর্ণমালার সঙ্গে মানিয়ে নিতে আগামীতে ভাষাভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
অবশ্য খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী বলেছেন, ‘সরকারের এটি সময়োপযোগী ভালো উদ্যোগ। ভাষাভিত্তিক প্রশিক্ষিত শিক্ষক তৈরির কাজ চলছে। চলমান সমস্যা কাটিয়ে ওঠে নতুন ব্যবস্থার সঙ্গে মানিতে নিতে কিছুটা সময় লাগছে।’
পার্বত্য চুক্তি, আইএলও কনভেনশনসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আইনের তাগাদা এবং দীর্ঘদিন ধরে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালুর দাবির প্রেক্ষিতে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে সরকার দেশের পাঁচটি মাতৃভাষার প্রাক প্রাথমিকে পাঠ্যপুস্তক প্রবর্তন করে। ফলে অন্যান্য শিশুদের মতো পাহাড়ি শিশুরাও মাতৃভাষায় বই পেয়ে আনন্দিত।
আরও পড়ুন: ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় বই : উদ্যোগ ভালো, সমস্যা পড়ানো নিয়ে
অভিভাবক ও শিক্ষকদের আগ্রহের কমতি নেই। প্রথম দফায় পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরাদের ভাষায় বই ছাপানো হয়েছে। এ ছাড়া সমতলের সাদ্রি ও গারো শিশুরাও নিজেদের ভাষায় পাঠ্যপুস্তক পেয়েছে। ২০১৭ খিষ্টাব্দে প্রাক-প্রাথমিক; এবং পর্যায়ক্রমে এ বছর তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষায় ছাপা হয়।
মূলত মায়ের ভাষায় পাঠ্যপুস্তক পড়তে না পারায় পাহাড়ি শিশুর ঝরে পড়ার হার ছিল আশঙ্কাজনক। ভাষা ভীতির কারণেও অনেকে স্কুল ফাঁকি দিত। সেই ভয় কাটাতে সরকার মাতৃভাষাভিত্তিক প্রাক-প্রাথমিক স্কুল চালুর ফলে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা দেয়।
কিন্তু বর্ণমালার সঙ্গে অপরিচিতি, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ না থাকা এবং পরিকল্পিত উদ্যোগের অভাবে চার বছরেও স্কুলে মাতৃভাষার পাঠ্যপুস্তক পড়ানো নিয়ে টেকনিক্যাল সমস্যা কাটছে না। তাই মাতৃভাষাভিত্তিক প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগ এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে (পিটিআই) তা অন্তর্ভুক্তির ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
ত্রিপুরা ভাষা কমিটির সদস্য ও মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম চালুর অন্যতম উদ্যোক্তা সংগঠক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা মাতৃভাষায় শিক্ষাক্রম চালুর উদ্যোগকে স্বাগত জানান। তিনি বলেন, ‘বিদ্যালয়গুলোতে পুরোদমে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালুর জন্য আরো অনেক পথ বাকি রয়েছে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বিশেষত: স্থানীয় প্রশাসনকে আরো কার্যকরভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। তিন পার্বত্য জেলায় শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (পিটিআই) মাতৃভাষায় শিক্ষার ওপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি।’ পিটিআইয়ের কারিকুলামে মাতৃভাষার শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করারও দাবি জানান তিনি।
মারমা ভাষা কমিটির সদস্য ডা. অংক্যজাই মারমাও শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
এ প্রসঙ্গে কমলছড়িমুখ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমার স্কুলটি শতভাগ চাকমা অধ্যুষিত। কিন্তু শিক্ষার্থীদের চাকমা ভাষায় পাঠদান করাতে পারছি না। কারণ প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব। মাতৃভাষায় শিক্ষা নিশ্চিত করা গেলে ঝরে পড়ার হার একদমই কমে যেত।’ তবে, জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে বলে জানান তিনি। সকল শিক্ষকের প্রশিক্ষণ দেয়া সম্ভব হলে সমস্যার সমাধান হবে।
এবার খাগড়াছড়ি জেলায় প্রাক-প্রাথমিক স্তরে ১১ হাজার ৬৪৩ জন, প্রথম শ্রেণিতে ১০ হাজার ৪৫৫ জন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৯ হাজার ২৯২ জন, ৯ হাজার ১৬৫ জন চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা শিশু মাতৃভাষার বই পেয়েছে বলে জেলা শিক্ষা অফিস সূত্র জানিয়েছে। মাতৃভাষার বই এর সঙ্গে মাতৃভাষার বর্ণমালাভিত্তিক অনুশীলন খাতাও বিতরণ করা হয়।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফাতেমা মেহের ইয়াসমিন জানিয়েছেন, খাগড়াছড়ি পিটিআইয়ের মাধ্যমে প্রত্যেক শিক্ষককে মাতৃভাষার প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ইতোপূর্বে ৯০ জন শিক্ষককে মাতৃভাষার পাঠ্যসূচি অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।