সরকারি হিসাবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার ৯৮ শতাংশেরও বেশি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর প্রথম শ্রেণিতে প্রায় ৩২ লাখ শিশু ভর্তি হয়। এর ২ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৬০ হাজার শিশু এখনো মাতৃভাষায় শিক্ষার আওতায় আসেনি। তবে যারা এখনো বিদ্যালয়েই যায়নি তাদের প্রকৃত কোনো পরিসংখ্যান নেই। বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা একেবারে কম নয়।
জানা যায়, যেসব এলাকা ও জনগোষ্ঠীর শিশুরা এখনো বিদ্যালয়ের বাইরে আছে, তাদের মধ্যে হাওর এলাকা, বেদে জনগোষ্ঠী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী, চর এলাকার শিশু, বস্তির শিশু, দলিত জনগোষ্ঠী, বস্তির শিশু, অতি মাত্রায় দরিদ্র এবং চা বাগানের শিশুরা অন্যতম।
গণসাক্ষরতা অভিযান এ ব্যাপারে ২০১৫ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সেখানে বলা হয়েছিল—২০১৩ সালে ছয় থেকে দশ বছর বয়সী বিদ্যালয়বহির্ভূত শিশুর সংখ্যা ছিল ১০ লাখ। আর একই সালে ১১ থেকে ১৪ বছর বয়সী বিদ্যালয়বহির্ভূত শিশুর সংখ্যা ছিল ১৮ লাখ।
তবে বেসরকারি একাধিক উন্নয়নকর্মী জানিয়েছেন, ২০১৩ সালের তথ্যের চেয়ে বিদ্যালয়বহির্ভূত শিশুর সংখ্যা অনেক কমেছে। বর্তমানে সরকারি হিসাবে যে সংখ্যক শিশুকে ভর্তির বাইরে দেখানো হয়েছে, সংখ্যাটা এর চেয়ে কিছুটা বাড়তে পারে। তবে মোট বিদ্যালয়বহির্ভূত অর্থাৎ ছয় থেকে ১৪ বছর বয়সী বিদ্যালয়বহির্ভূত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ভর্তি না হওয়া শিক্ষার্থীর কয়েক গুণ হবে।
২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংক তাদের এক পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলেছিল, বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যের দিকে দ্রুত পায়ে এগোচ্ছে। পথে এখনো অল্প কটি বাধা আছে। সবচেয়ে বড় বাধা সামনে রয়ে গেছে, সেটি হচ্ছে বিদ্যালয়ের বাইরে থাকা এবং ভর্তি না হতে পারার ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা। বিশেষ করে বস্তিবাসী শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা। মূলত দারিদ্র্যের কারণে এখনো ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত ৫০ লাখের বেশি শিশু বিদ্যালয়ের বাইরে থেকে গেছে। তারা কখনোই বিদ্যালয়ে যায়নি। শহরের বস্তিতে এবং প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বাস করা শিশুদের ঝরে পড়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
বিশ্বব্যাংক ২০১৫ সালে এ তথ্য প্রকাশ করলেও তাদের তথ্য আরো পুরনো। আর সে প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিদ্যালয়বহির্ভূত শিক্ষার্থীর সংখ্যা নিয়ে তখনই প্রশ্ন উঠেছিল।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রাক-প্রাথমিক স্তরে ভর্তির হার বাড়িয়ে শিখনের অসমতা কমিয়ে আনতে হবে। যদিও প্রাক-প্রাথমিক স্তরে শিশুদের সংখ্যা বাড়ছে, তবু এখনো তাদের ভর্তির হার কম। সেটা বাড়াতে পারলে বিদ্যালয়বহির্ভূত শিক্ষার্থীর সংখ্যা একেবারেই কমে আসবে।
জানা যায়, সরকার বিনা মূল্যে বই বিতরণ, উপবৃত্তি প্রদান, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের মাধ্যমে আনন্দময় শিক্ষাসহ নানা ব্যবস্থার কারণে শিশুরা বিদ্যালয়মুখী হয়েছে। তবে এখনো প্রায় ১৮ শতাংশ শিশু প্রাথমিকের গণ্ডি শেষ করার আগেই ঝরে যাচ্ছে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ২০১৭ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে প্রাথমিক শাখা রয়েছে এমন বিদ্যালয়ের সংখ্যা এক লাখ ৩৩ হাজার ৯০১টি। এতে পড়ালেখা করে এক কোটি ৭২ লাখ ৫১ হাজার ৩৫০ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে বালক ৮৫ লাখ ৮০৩ জন এবং বালিকা ৮৭ লাখ ৪৩ হাজার ৩১২ জন।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর তাদের প্রতিবেদনে বলছে, বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া ও আনুষ্ঠানিক শিক্ষাবহির্ভূত আট থেকে ১৪ বছর বয়সী এক লাখ ৯০ হাজার শিশুকে রিচিং আউট অব স্কুল চিলড্রেন (রস্ক) প্রকল্পের আওতায় শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।
জানা যায়, হাওড়, চর এলাকা, চা বাগান ও পাহাড়ি এলাকায় বিদ্যালয়ের স্বল্পতা রয়েছে। বেশ দূরে বিদ্যালয়ের অবস্থান হওয়ায় কিছু শিশু বিদ্যালয়ে যেতে পারে না। এ ছাড়া বেদে জনগোষ্ঠীর শিশুদেরও তেমনভাবে বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ তারা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। প্রতিবন্ধী শিশুদের অনেক সময় অভিভাবকরাও বিদ্যালয়ে পাঠাতে চান না। আবার তাদের উপযোগী বিদ্যালয়ও তেমন একটা নেই। আর অতিমাত্রায় দরিদ্র হওয়ায় অনেক বস্তিবাসীই তাদের সন্তানকে বিদ্যালয়ে না দিয়ে কাজে পাঠিয়ে দেয়।
জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ বলেন, ‘সব শিশুকে বিদ্যালয়ে নিয়ে আসার জন্য একটি জাতীয় উদ্যোগ চাই। এ জন্য প্রথমে একটি জরিপ দরকার, কতজন শিশু শিক্ষা বঞ্চিত রয়েছে, তা আগে বের করা দরকার। এরপর অন্য দেশ কিভাবে এসব সমস্যা সমাধান করেছে তা জেনে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে ভাসমান জনগোষ্ঠীর জন্য ভাসমান বিদ্যালয় করতে হবে। আর যদি একটা স্থায়ী শিক্ষা কমিশন করা যেত তাহলে তারাই এসব ব্যাপারে চিন্তা করতে পারত।’
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ