দেশব্যাপী আলোচিত মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। বলা হচ্ছে, সামাজিকভাবে এটা প্রতিরোধ করতে হবে, অন্যথায় মাদক পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ঘোষিত জিরো টলারেন্সে মাদক ক্রেতা ও গ্রহিতার হার কমানো যাবে না।
সমীক্ষা বলছে, দেশে মাদক গ্রহণ ও পাচারের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে নবীন প্রজন্মের সেই অংশকেও যাদের বয়স ৫ থেকে ১১-র মধ্যে। অর্থাত্ আমার ছোট্ট ছেলেটি কিংবা মেয়েটি যার অক্ষরজ্ঞান পর্যন্ত নেই এবং মূলত যে ভাসমান, পথশিশু তাকে যুক্ত করা হচ্ছে এই ভয়াবহ অপরাধে। এর পর ধাপে ধাপে বিদ্যালয়ের ১৪ থেকে ১৬, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের কিশোর-তরুণেরা জড়িয়ে যাচ্ছে এই জালে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিকে পা রাখা আমার সপ্তম থেকে দশম শ্রেণির শিশুটিকে যখন মাদক গ্রহণ ও পাচারে ব্যবহার করা হয়, তখন তা থেকে তাকে বিরত রাখার দায় কি একা পরিবারের? এটা ঠিক, পারিবারিক বন্ধন, বিশেষত যখন তার বয়ঃসন্ধির সময়, অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে দিনের অধিকাংশ সময়ই, ন্যূনতম আট ঘণ্টা একটা শিশু কাটায় বিদ্যালয়ে, সহপাঠী পরিবেষ্টিত অবস্থায়, শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে। এখন এই শিশুটিকে মাদকমুক্ত রাখার দায়িত্ব কিন্তু অনেকাংশেই বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ওপর বর্তায়। একটি শিশুর মনস্তত্ত্ব যাচাই করে তাকে ব্যস্ত রাখতে হবে নানা সৃজনশীল কাজে। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বৃক্ষরোপণ, হোক তা টব কিংবা ব্যবহূত পাস্টিকের বোতলে, কবিতা ছড়া কিংবা গল্প লেখা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে, সমসাময়িক বিষয়ের ওপর রচনা ও কুইজ প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করে, বই পড়া আন্দোলনকে জোরদার করে, সময়োপযোগী চলচ্চিত্র উত্সবের আয়োজন করে, চিত্রাঙ্কন ও স্থিরচিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে, নাটক, গান, আবৃত্তি ও বিতর্ক অনুষ্ঠান আয়োজন করে শিক্ষকরা অনায়াসে তা করতে পারেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি এইসব সৃজনশীল কাজ নিঃসন্দেহে শিশুদের ব্যস্ত রাখবে, নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখাও আর তখন একঘেয়ে নীরস মনে হবে না। শিশুদের মূলত ব্যস্ত রাখা হলেই তাদের অসত্ সঙ্গদোষে মাদকের ওপর কৌতূহল সৃষ্টি কিংবা অনাগ্রহে মাদক একবার গ্রহণ করার পর তার প্রতি নেশা তৈরি হওয়ার কোনো সুযোগই থাকবে না।
বলতে দ্বিধা নেই, রাজধানীসহ দেশের একটা বড় অংশে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কোচিং বাণিজ্যসহ নানান অভিযোগ রয়েছে। কোমলমতি শিশুদের মাদকসহ যে কোনো অন্যায়ের পথ থেকে ফেরাতে তাদের সমন্বিত ও কার্যকর উদ্যোগ দরকার, দরকার আন্তরিকতা ও শিক্ষার্থীদের প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা। নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলতে না পারলে যা একরকম অসম্ভব হয়ে পড়বে।
মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এর মূলোত্পাটন করতে সমাজের তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করা উচিত। আর এক্ষেত্রে শিশুদের মাদকমুক্ত রাখার দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করতে হবে সবার প্রথমে। একজন শিক্ষক, তাঁর শিক্ষার্থীদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করে এই হার নিঃসন্দেহে কমিয়ে আনতে পারেন শতকরা আশি শতাংশ। শুধু দরকার তাদের এগিয়ে আসার মানসিক দৃঢ়তা।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক