১৯ জুলাই, ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রণীত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (মাদরাসা) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালাতে আলিম, ফাযিল ও কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগের জন্য প্রণীত নীতিমালার যৌক্তিক সমলোচনাসহ সংশোধন করার জন্য কর্তৃপক্ষের নিকটে অনুরোধ করছি।
আলিম মাদরাসার অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পদ
আলিম মাদরাসার অধ্যক্ষ পদের জন্য ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে কামিল বা স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় হতে সমমানের পাস। এখানে কোনো শ্রেণি বা বিভাগ উল্লেখ নেই। অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছেÑ উপাধ্যক্ষ বা সহকারী অধ্যাপক পদে তিন বছরের অভিজ্ঞতাসহ প্রভাষক আরবি পদে ১২ বছরের অভিজ্ঞতা বা দাখিল মাদরাসার সুপার হিসাবে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতাসহ ১৫ বছরের আরবি বিষয়ে পাঠদানের অভিজ্ঞতা। উপাধ্যক্ষ পদের জন্য একই শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ সহকারী অধ্যাপক পদে তিন বছরের অভিজ্ঞতা অথবা দাখিল মাদরাসার সুপার বা সহসুপার হিসাবে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতাসহ ১৫ বছরের আরবি বিষয়ে পাঠদানের অভিজ্ঞতা।
অধিকাংশ সিনিয়র প্রভাষকগণ উচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতা, দক্ষতা, মেধাবী হওয়া স্বত্ত্বেও সহকারী অধ্যাপক পদে তিন বছরের অভিজ্ঞতা না থাকায় তিনি অধ্যক্ষ বা উপাধ্যক্ষ পদে আবেদন করতে পারছেন না। অথচ সহকারী অধ্যাপক হন ৫:২ অনুপাতে এবং জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে। যিনি এই আওতায় পড়বেন না, তিনি অধ্যক্ষ বা উপাধ্যক্ষ পদে আবেদন করতে পারবেন না। যা অব্যশই বাতিল হওয়া উচিত। দাখিল মাদরাসার স্তর উন্নয়ন ছাড়া অধ্যক্ষ পদের নিয়োগের জন্য সুপার পদের অভিজ্ঞতা কীভাবে শর্ত করা হলো, তা বোধগম্য নয়। একজন সিনিয়র প্রভাষক ১৫-২০ বছর সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করছেন, কিন্তু অনুপাত নামের ‘কালো আইনে’র কারণে সহকারী অধ্যাপক পদ পাননি। তাই তিনি অধ্যক্ষ বা উপাধ্যক্ষ পদে আবেদনেরও যোগ্য নন। অথচ একজন সুপার পদে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা থাকলে তিনি অধ্যক্ষ পদে আবেদনের যোগ্য হবেন, যা সত্যি অপমানজনক। দাখিল মাদরাসার স্তর উন্নয়ন ছাড়া সুপার পদের অভিজ্ঞতা কীভাবে আলিম মাদরাসা তথা কলেজ পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানে নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে গ্রহণ যোগ্য হয়? আরো আশ্চর্যজনক সত্য যে, দাখিল মাদরাসার সহসুপার পদের অভিজ্ঞতা আলিম মাদরাসার উপাধ্যক্ষ পদে জায়েয করা হলো, কিন্তু একজন সিনিয়র প্রভাষক উচ্চতর ডিগ্রি, দক্ষতা, অভিজ্ঞতাসহ প্রভাষক পদে বেতন কোড ৭-এ চাকরি করেন। আর সহসুপার বেতন কোড ৮-এ চাকরি করেন। আলিম মাদরাসার উপাধ্যক্ষ পদে দাখিল মাদরাসার সহসুপার আবেদন করতে পারবেন, অথচ একজন সিনিয়ন প্রভাষক আবেদন করতে পারবেন না। এটি কোনো আইন হতে পারে?
ফাযিল মাদরাসার অধ্যক্ষ পদ
অধ্যক্ষ বা উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড হতে শুধু কামিল পাস বা স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় হতে সমমানের ডিগ্রি অথবা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় বা স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় হতে থিওলজি, আরবি ও ফিকাহ্ বিভাগ হতে অনার্স ও স্নাতকোত্তর পাস বা সমমান। অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে কামিল বা ফাযিল মাদরাসার উপাধ্যক্ষ পদে তিন বছরের অভিজ্ঞতাসহ তাফসির, হাদিস, আদিব ও ফিকাহ্ বিষয়ে সহকারী অধ্যাপক বা প্রভাষক পদে ১৫ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা। অধ্যক্ষ পদে অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে উল্লে¬খিত বিষয়ে সহকারী অধ্যাপক পদে তিন বছরের অভিজ্ঞতাসহ ১২ বৎসরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা। অথবা আলিম মাদরাসার উপাধ্যক্ষ হিসাবে তিন বছরের অভিজ্ঞতাসহ সহকারী অধ্যাপক বা প্রভাষক হিসাবে আরবি বিষয়ে ১২ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা।
বিধি পর্যালোচনা
একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধানের শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও নিষ্ঠার ওপরই প্রতিষ্ঠানের উন্নতি ও সফলতা নির্ভর করে। সুতরাং তার শিক্ষাগত যোগ্যতা যদি অধীনস্থদের থেকে দুর্বল হয় তবে তিনি অধীনস্তদের নিকট মানসিকভাবে দুর্বল থাকবেন। প্রতিষ্ঠান প্রধানের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা শুধু পাস ডিগ্রি হবে এটি কখনও অধ্যক্ষ বা উপাধ্যক্ষ সম্মানজনক দু’টি পদ ও স্কেলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এইচএসসি ও ডিগ্রি কলেজের সমপর্যায়ের প্রতিষ্ঠান আলিম ও ফাযিল মাদরাসার অধ্যক্ষ বা উপাধ্যক্ষ পদে শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি অবশ্যই সর্বজন গ্রহণযোগ্য ও বাস্তবসম্মত উঁচু মানের হওয়া উচিত। আলিম, ফাযিল মাদরাসার অধ্যক্ষ বা উপাধ্যক্ষ পদের জন্যে সহকারী অধ্যাপক বা সিনিয়র প্রভাষক প্রচুর রয়েছেন। কিন্তু আইন করা হয়েছে এর বিপরীত। আইনটি অবশ্যই সংশোধন হওয়া জরুরি।
প্রণীত আইন সংশোধন করে যা বাতিল ও যুক্ত করা উচিত
১. আলিম, ফাযিল ও কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ বা উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় বা ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রথম শ্রেণির কামিলসহ সমগ্র শিক্ষা জীবনে যে কোনো ৩টির ২টিতে প্রথম শ্রেণি বা বিভাগ আবশ্যক করা জরুরি। এমফিল বা পিএইচডিধারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
২. সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে কালো আইন ৫:২ বাতিল করে প্রভাষকগণ তাদের চাকরির মেয়াদ ৮-১০ বছর পূর্তিতে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি প্রাপ্তির নিয়ম চালু করা।
৩. ফাযিল মাদরাসার অধ্যক্ষ বা উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে উপাধ্যক্ষ বা সহকারী অধ্যাপকের তিন বছরের অভিজ্ঞতার শর্ত বাতিল করা।
৪. আলিম ও ফাযিল মাদরাসার অধ্যক্ষ বা উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সহকারী অধ্যাপক ১২ বছর বা প্রভাষক পদে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতার শর্ত আরোপ করা।
৫. বেতন গ্রেড-৭, বেতন স্কেল ২৯ হাজার টাকায় চাকরি করে একজন সিনিয়র প্রভাষক ৫:২ অনুপাতের কারণে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাননি। এ কারণে তিনি উপাধ্যক্ষ পদে আবেদনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। অথচ একজন সুপার সিনিয়র প্রভাষকের সমগ্রেডে ও সহসুপার সিনিয়র প্রভাষকের নিচের বেতন গ্রেড ৮-এ চাকরি করে তিনি উপাধ্যক্ষ পদে আবেদনের যোগ্য হবেন এ রকম আইন বাতিল করা।
৬. ফাযিল মাদরাসার অধ্যক্ষ বা উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে শুধু আলিম মাদরাসার অধ্যক্ষ বা ফাযিল মাদরাসার উপাধ্যক্ষ বা আলিম-ফাযিল মাদরাসার সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক পদের অভিজ্ঞতার শর্ত আরোপ করা।
৭. আলিম-ফাযিল মাদরাসা অধ্যক্ষ বা উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে স্তর উন্নয়ন ছাড়া (দাখিল মাদরাসা আলিম স্তর ও আলিম মাদরাসা ফাযিল স্তরে উন্নীত ছাড়া) অধ্যক্ষ বা উপাধ্যক্ষের শূন্যপদ পূরণের জন্য দাখিল মাদরাসার সুপার বা সহসুপার পদের অভিজ্ঞতার শর্ত বাতিল করা।
৮. ১৯ জুলাই, ২০১৮ জারিকৃত পরিপত্রের আগে আলিম মাদরাসায় উপাধ্যক্ষের কোনো পদই ছিল না। অথচ ফাযিল মাদরাসার উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে আলিম মাদরাসার উপাধ্যক্ষ হিসাবে তিন বছরের অভিজ্ঞতার শর্তযুক্ত করা হয়েছে, যা হাস্যকর। এরকম হাস্যকর আইন বাতিল করা উচিত।
৯. সংকীর্ণতা পরিহার করে জেনারেল বিষয়ে যোগ্য ও অভিজ্ঞ প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক ও উপাধ্যক্ষদের অধ্যক্ষ বা উপাধ্যক্ষ পদে আবেদনের সুযোগ দেয়া।
১০. বিভাগ ওয়ারি অধ্যক্ষ বা উপাধ্যক্ষ শূন্যপদে নিয়োগের জন্য উপাধ্যক্ষ, সহকারী অধ্যাপক বা প্রভাষকদের মধ্য থেকে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারিভাবে নিয়োগের ব্যবস্থা করা।
লেখক: প্রভাষক (আরবি), শাহ্জুই কামিল মাদরাসা, পাংশা, রাজবাড়ী।