কয়েক বছর আগে (২০১১) ইথিউপিয়ায় একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলাম । স্বাভাবিক কার্যক্রমের ফাঁকে পৃথিবীর পঞ্চাশাধিক দেশের প্রতিনিধির সঙ্গে আদ্দিস আবাবার জাদুঘর পর্যবেক্ষণের সুযোগ ঘটেছিল। সেখানেই রক্ষিত আছে এক সময় দুনিয়ার বহুল আলোচিত অতি প্রাচীন মানবী লুসির কঙ্কাল।
যখন ছোট্ট (বামনাকৃতির) কথিত আদি মানবী লুসির কঙ্কাল সম্পর্কে বিজ্ঞ কিউরেটর বর্ণনা দিচ্ছিলেন তখন দুই-একটি বাক্য আমি বুঝতে পারছিলাম না। গাইডের শরণাপন্ন হলাম, কিউরেটর সেই বাক্যগুলো পুনরাবৃত্তি করলেন এবং আরো বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিলেন । তাঁর মূল কথাটি ছিল, ‘মানুষ যা কিছু ভাবুক না কেন, যা কিছুই পড়ুক না কেন, তাতে ঘুরেফিরে নৃবিজ্ঞান থাকবেই।’ শনিবার (১৩ জুলাই) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধনটি লিখেছেন ইমদাদ সিয়াধার।
গ্রামের রাস্তার পাশে পড়ে থাকা ভাঙা সানকি, গুলিস্থানের (বর্তমানে ওসমানী উদ্যানে) কামান বা ঢাকা জাদুঘরের সম্মুখে সারিবদ্ধ কামান, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার আসকান বা বাদশাহ আওরঙ্গজেবের স্বহস্তে লিখিত পবিত্র কোরআনের কপি, কোনো মন্দিরের সেজ, পীরের মাজারের মোমদানি—এসবই তো নৃবিজ্ঞানের আলোচ্যভুক্ত সামগ্রী।
চার-পাঁচ দশক আগে আমাদের বাড়িতে দেখা সংরক্ষিত শত বছরের পুরাতন মহিষের শিং, হরিণের শিং, হাতির দাঁত, কাইম (কালিম) পাখির শুকনো চঞ্চু আমার মনে বিষ্ময় জাগাত। এগুলি মূলত মানবের সঙ্গে সম্পর্কিত, নৃবিজ্ঞানের আলোচ্য বস্তু বটে। জীবনপথের তাবত্ বিষয়-আশয়, সকল সামগ্রীই কোনো এক সময় নৃবিজ্ঞানের আলোচনায় এসে পড়ে।
নৃবিজ্ঞান মানুষকে নিয়েই আলোচনা করে। বিশেষ করে মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক জীবন ধারণের বিষয়-আশয় নিয়ে অধ্যয়নের জন্য এ বিষয়টি আলোচিত হয়। যে কারণে বলা হয়ে থাকে, মানুষকে সামগ্রিকভাবে বুঝতে নৃবিজ্ঞানের গবেষণার বিকল্প নেই। এক কথায় নৃবিজ্ঞানের ভাবনার বাইরে মানব জীবনের কোনো পর্যায় নেই।
বিজ্ঞ বিচারক, অভিজ্ঞ চিকিত্সক, জ্ঞানী প্রকৌশলী, নিপুণ অপরাধবিজ্ঞানী যিনি যাই হোন না কেন, কাজ তো একটাই; জগতের সবচেয়ে বিষ্ময়কর প্রাণী মানুষ নিয়েই নাড়াচাড়া করা। আর সেখানে তো অবশ্যই মানবের গতি-প্রকৃতি নিয়ে ভাবনা নিহিত। যার শেষ কথা মানবের সকল কিছুই আবর্তিত হয় নৃবিজ্ঞানের মাঝে।
দেশের আটটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও তার বাইরে আরো বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীত বিষয়ে নৃবিজ্ঞানও অন্যতম। যা উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হয়ে পড়তে হয়। ব্যতিক্রম ব্যাপার হলো ছাত্ররা মাধ্যমিক বা উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যায়ে নৃবিজ্ঞানের ধারাবাহিক জ্ঞানার্জনের সুযোগ পায় না। আমাদের কারিকুলামে সে ব্যবস্থা নেই। বিষয়টি বড় বেমানান।
শিক্ষা গবেষকবৃন্দ নিশ্চয়ই একমত হবেন যে, উচ্চ পর্যায়ে যা অধ্যয়ন করবে সে বিষয়টির সুস্পষ্ট আঁচ তাকে আগেই পেতে হবে। বিশ্বব্যাপী কারিকুলাম প্রণয়নের একটি সার কথা হলো, পঠন আর অধ্যয়ন এক কথা নয়। একটি উপন্যাস বা গল্পেও নৃবিজ্ঞানের অনেক উপাদান থাকতে পারে, কিন্তু সুশৃঙ্খল একাডেমিক জ্ঞান লাভের জন্য অধ্যয়ন করতে প্রয়োজন প্রাকধারণা-জ্ঞান-অভিজ্ঞতা। তবেই না কারিকুলাম বাস্তবায়ন যথার্থ হবে।
সে দৃষ্টিতে মাধ্যমিক পর্যায় থেকেই শিক্ষার্থীকে জ্ঞান দিতে হবে মানুষের বিস্ময়কর সত্তা সম্পর্কে, আলোচনা করতে হবে মানুষ নিয়ে, মানুষের সাংস্কৃতিক দিক নিয়ে, মানব সম্পর্কিত বিষয়-আশয় নিয়ে। খণ্ডিতভাবে নয়, সকল কালের মানুষ নিয়ে, সকল জাতি, বর্ণ গোষ্ঠী নিয়ে। অর্থাত্ সামগ্রিকভাবে মানুষকে বুঝতে সহায়তা করতে হবে। নৃবিজ্ঞান যেহেতু রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে রন্ধনশালা পর্যন্ত বিস্তৃত, এটিকে অবহেলা বা পাশ কাটানোর অবকাশ নেই।
কাজেই শিক্ষা গবেষক ও নীতি নির্ধারকসহ সংশ্লিষ্ট সবার কাছেই সনির্বন্ধ অনুরোধ: অবিলম্বে নৃবিজ্ঞানকে মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠ্যতালিকাভুক্তির সদয় ব্যবস্থা নেওয়া হোক।