মানুষের মাথায় চুল কম, স্থূল দেহ, ছেলেমেয়েরা খাটো হয়ে যাচ্ছে, মেয়েরা সংখ্যায় বেশি খাটো, স্কুল পড়ুয়াদের পড়াশোনায় মন বসে না, স্মরণশক্তি ও ধৈর্য-ক্ষমতা কম ইত্যাদি বিষয় আজকাল লোকসমাজে আলোচনা হয়। মা-বাবা ,ভাই-বোন, শিক্ষক, আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি স্নেহ-মমতা ও শ্রদ্ধাবোধ কম, আকর্ষণ কম, সহজে রেগে যায়, স্থিরতা নেই, সচেতনতার অভাব ইত্যাদি যেন তাদের দেহ-মনে বাসা বানিয়েছে। তাছাড়া নানা রোগব্যধি তো লেগে আছেই। এসব ঘটনা দেহে আয়োডিনের অভাবের কারণে হতে পারে।
আয়োডিন একটি উদ্বায়ী মৌলিক পদার্থ, খোলা অবস্থায় থাকলে বাতাসে উবে যায়। আয়োডিনের ঘাটতি বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাববিস্তারক সমস্যা, যা মস্তিষ্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করে দেয়।
আয়োডিনের অভাব হয় শিশু জন্মের আগেই। মহিলাদের গর্ভবতী অবস্থায় আয়োডিনের ঘাটতি বেশি হলে মৃত সন্তান প্রসব, গর্ভপাত, শিশুর জন্মগত অস্বাভাবিকতা, বামনত্ব এবং অনিরাময়যোগ্য সমস্যার সৃষ্টি করে।
আয়োডিনের প্রধান উৎস হল মাটি ও সমুদ্র। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুসারে এদেশের মাটিকে আয়োডিন ঘাটতি এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ফলে দেশে উৎপাদিত শাক-সবজি, ফল-মূল, গো-মাংস, দুধ, দই, ডিম ইত্যাদিতে অন্যান্য দেশের মতো আয়োডিন নেই। এদেশে সামুদ্রিক শৈবাল, সামুদ্রিক উদ্ভিদ ও মাছে আয়োডিন আছে কি না তা জানা প্রয়োজন। অনেক দেশে পাউরুটি, দই, বিস্কুট, পানি, লবণ ইত্যাদিতে আয়োডিন মিশিয়ে মানব দেহের প্রয়োজনীয় ঘাটতি পূরণ করা হয়। আমাদের দেশে আয়োডিনযুক্ত লবণ খাওয়া ছাড়া এ অভাব পূরণ করার কোনো সুযোগ নেই।
শরীরের বৃদ্ধি এবং খাবার হজমে প্রধান ভূমিকা রাখে থাইরয়েড হরমোন আর হরমোনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হল আয়োডিন। মানুষের বুদ্ধি বা শেখার ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রধান কারণ এই আয়োডিন। সরকার লবণে আয়োডিন যোগ করায় দৃশ্যমান গলগণ্ড রোগ দেশ থেকে বিদায় নিয়েছে বলা যায়। বর্তমানে আয়োডিনের অভাব হয়ত কমেছে, তবে গলগণ্ড ছাড়া অন্যান্য সমস্যা যে বৃদ্ধি পায় নাই তা জোর দিয়ে বলার সুযোগ নেই।
২০১৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমের আয়োডিন বিষয়ক তথ্য আমাকে অনেক নাড়া দিয়েছে। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম, আর্টিকেল, জার্নালের সাহায্য নিতে হয়েছে। লবণে আয়োডিন আছে কিনা, কতদিন থাকে, ভোক্তা পর্যন্ত কতটুকু পাওয়া যায়, গৃহে সংরক্ষণ প্রক্রিয়া সঠিক কি না, প্যাকেট ঠিক আছে কি না, সংরক্ষণ বিষয়ে জনসচেতনতা কতটুকু আছে ইত্যাদি প্রশ্নের জবাব খোঁজার চেষ্টা করি। নির্ভরযোগ্য তথ্যের জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞ , বিশেষজ্ঞ ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সাথে কথা বলেছি।
আমরা যে লবণ খাই তার নাম সোডিয়াম ক্লোরাইড। এই লবণ এবং এতে থাকা সোডিয়াম আমরা কতটুকু খেতে পারব তার একটি আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড নির্দিষ্ট করে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, কারণ এই লবণ ও সোডিয়াম বেশি খেলে জীবন- ঝুঁকিপূর্ণ রোগ হয়ে থাকে যেমন: উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, হার্ট- অ্যাটাক, কিডনি সমস্যা, মস্তিষ্কের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ মোতাবেক একজন মানুষকে দৈনিক সর্বোচ্চ ৫ গ্রাম লবণ খাবার নির্দেশনা দিয়েছে। বিশ্বের প্রতিটি দেশ তা অনুসরণ করে । এই লবণে (সোডিয়াম ক্লোরাইড) থাকা সোডিয়াম একজন মানুষ দৈনিক গ্রহণ করবে সর্বোচ্চ ২ গ্রাম (২০০০ মিলিগ্রাম)। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তা থেকে আরো কমানোর নির্দেশনা দিয়েছে। বিশ্বের প্রতিটি দেশ তা অনুসরণ করে ।
২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ২০ নভেম্বর, রোববার বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশিত “জাতীয় লবণ নীতি ২০১৬” তে উল্লেখ করা আছে- প্রতিদিন প্রতিজনের ভোজ্য লবণ ব্যবহারের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪.৫ গ্রাম। এটা কে আদর্শ মাপকাঠি ধরেই লবণে আয়োডিন মেশানো হয় ।
লবণে আয়োডিনের পরিমাণ এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে যে, প্রতিজন প্রতিদিন ১৪.৫ গ্রাম আয়োডিনযুক্ত লবণ খেলে চাহিদা পূরণ হবে । ১৪.৫ গ্রাম লবণে সোডিয়াম আছে কমপক্ষে ৬৬০০ মিলিগ্রাম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ, সোডিয়াম পরিমাণ ২০০০ মিলিগ্রামের স্থলে আমরা খাচ্ছি প্রতিজন দৈনিক ৬৬০০ মিলিগ্রাম। এটা যে কত ভয়াবহ ও আতঙ্কের খবর তা আমাদের দেশের পুষ্টি বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসাবিদ এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বুঝতে না পারে, তাহলে এটা অত্যন্তও দুঃখজনক খবর। অতিরিক্ত লবণ বা সোডিয়াম খাওয়ার ফলে, মস্তিষ্কের নিউরোনকেও প্রভাবিত করে। কোলন ক্যানসার, পাকস্থলীর ক্যানসার ও শরীরে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া সহ মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।
কানাডার একটি সরকারি তথ্য বিবরণী উল্লেখ করাটা প্রয়োজন মনে করছি- তারা অনেক লবণ খায়, ফলে গড়ে দৈনিক জনপ্রতি সোডিয়াম খাওয়া হয় ২৭৬০ মিলিগ্রাম। তাই সেদেশে ২০ বছরের উপরে প্রতি চারজনে একজন উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয় এবং তাদের মধ্যে শতকরা ৩০ জন অতিরিক্ত সোডিয়াম খাওয়ার ফলে এ অবস্থা হয়। তাদের ২৭৬০ মিলিগ্রাম খেয়ে এই অবস্থা, সেখানে ৬৬০০ মিলিগ্রামের বেশি খেলে কী অবস্থা হওয়ার কথা তা সহজেই অনুমেয়। আমার মনে হয়, খুব কম পরিবার আছে যেখানে উচ্চ রক্তচাপের রোগী নেই। উচ্চ রক্তচাপের ফলে স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, কিডনি সমস্যা সহ যে কোনো সময় মৃত্যু ঝুঁকির সম্ভাবনা থেকে যায়।
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞান ইন্সিটিউটের পরিচালক প্রফেসর ড. শেখ নজরুল ইসলামের সাথে দেখা করলে তিনি লবণ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মহিদুজ্জামানের সাথে এ বিষয়ে কথা বলতে বলেন। অধ্যাপক মহিদুজ্জামানের কাছে জানতে চাই, “জাতীয় লবণ নীতি ২০১৬” অনুসারে জনপ্রতি দৈনিক ১৪.৫ গ্রাম লবণ কে স্ট্যান্ডার্ড ধরে আয়োডিন মেশানো হয়, আমাদের এত বেশি লবণ খাওয়াতে কোনো সমস্যা হবে কি না, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত মাত্রা থেকে অনেক বেশি? তিনি স্পষ্ট জবাব না দিয়ে বিসিক এর কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলতে বলেন।
লবণ বিষয়ক সরকারি তত্ত্বাবধানকারী প্রতিষ্ঠান বিসিক এর কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলি। দায়িত্বশীল বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা জনাব সরোয়ার হোসাইন জানান- আমরা আয়োডিনের মাত্রা ঠিক করতে দৈনিক জনপ্রতি ১৪.৫ গ্রাম লবণ খাওয়ার হিসেব করেছি। তিনি আরো জানান, ভবিষ্যতে এটি অবশ্যই গুরুত্বের সাথে মাথায় রাখবেন। আমার তথ্য সংগ্রহ, গবেষণা ও বিশ্লেষণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
১৪.৫ গ্রামে নয়, উন্নত দেশগুলোর মতো ৪ থেকে ৫ গ্রাম লবণের মধ্যে পরিমিত মাত্রার (কমপক্ষে ১৫০ মাইক্রোগ্রাম) আয়োডিন মেশাতে হবে। আয়োডিন যুক্ত লবণ বাসায় কাঁচের বা ফুডগ্রেড প্লাস্টিকের পাত্রে ঢাকনা বন্ধ করে সংরক্ষণ করতে হবে। এ ব্যাপারে পর্যাপ্ত জনসচেতনতা মূলক কাজ করতে হবে। এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
লেখকঃ সরকারি হাই-স্কুলের সাবেক শিক্ষক, গবেষক ও উদ্ভাবক।
[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন]