মানবিক বুয়েটে দানব তৈরির দায়ভার - দৈনিকশিক্ষা

মানবিক বুয়েটে দানব তৈরির দায়ভার

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বুয়েট শিক্ষার্থীদের র‌্যাগিংয়ে মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ গত ৭ অক্টোবর মাত্র ২১ বছর বয়সে এক পৈশাচিক হামলায় মৃত্যুবরণ করেন। তার অকালমৃত্যুতে জাতি হয়েছে স্তম্ভিত ও লজ্জিত। এই মৃত্যু কারও পক্ষে মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। আমরা বুয়েটের ছাত্র ছিলাম নব্বইয়ের দশকে। এই সময়কালে ক্যাম্পাস ছিল রাজনীতি, সংস্কৃতি ও বিতর্কে অংশগ্রহণে মুখরিত; ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, জামায়াত, বামদল ইত্যাদি ক্যাম্পাসে ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থান। ছিল না গেস্টরুম, গণরুম অথবা র‌্যাগিং কালচার। র‌্যাগিং নামে বড় ভাইয়েরা নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে ছোট ভাইদের রাজনৈতিক দলে কিংবা নিজেদের বশে আনতে এ ধরনের অমানবিক নির্যাতন চালানোর মর্মস্পর্শী ঘটনা আমার তেমন জানা ছিল না। এখন দেখছি, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা, মতপ্রকাশ করা, খাওয়া-দাওয়া করা, পোশাক-পরিচ্ছদ পরা, সালাম না দেওয়া, হুকুম পালন না করা ইত্যাদি হচ্ছে বড় ভাইদের দৃষ্টিতে এক গর্হিত অপরাধ। শুনেছি, রাজনৈতিক র‌্যাগিংয়ের চেয়ে অরাজনৈতিক র‌্যাগিং আরও বেশি। আবরার ফাহাদ রাজনৈতিক র‌্যাগিংয়ের শিকার। আসলে আমরা দিন দিন সংবেদনশীলহীন হয়ে যাচ্ছি। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসনের নাকের ডগায় ঘটছে এ ধরনের বিবেক-বিবর্জিত কর্মকাণ্ড। এ জঘন্য র‌্যাগিং কালচারের লাগাম টেনে না ধরতে পারলে জাতি আর কত হবে স্তম্ভিত ও লজ্জিত! শনিবার (২৬ অক্টোবর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন  ড. মো. শফিকুল ইসলাম।

বুয়েটে ভর্তি সম্পর্কে মোটামুটি সবাই অবগত। তবুও বলছি, দেশের প্রায় ১২ হাজার সর্বোচ্চ মেধাবী শিক্ষার্থী পরীক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে প্রায় ১০৫৫ জন ভর্তি হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করে। তারা জীবনের প্রতিটি পরীক্ষায় তীব্র প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অত্যন্ত ঈর্ষণীয় ফলধারী শিক্ষার্থী। শিক্ষাজীবনের প্রতিটি স্তরে তাদেরকে এত বেশি পড়াশোনা করতে হয় যে, রাজনৈতিক সংস্পর্শে আসার কোনো সুযোগই তাদের জীবনে ধরা দেয় না। আর বুয়েটে ভর্তি হওয়ার পর নিজেকে একজন যোগ্য প্রকৌশলী হিসেবে গড়ে তুলতে প্রচুর অধ্যবসায় করতে হয়। প্রতিটি ক্লাস, ব্যবহারিক, প্রজেক্ট, সেমিস্টার পরীক্ষা সম্পন্ন করার জন্য ব্যয় করতে হয় অনেক সময়, শ্রম ও মেধা। যে সময় ও মেধার বদৌলতে পরবর্তীকালে তাদের হাতে তৈরি হয় দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় অতিক্ষুদ্র একটি সার্কিট, মানুষের জীবনকে সহজ করে দেওয়া প্রযুক্তি বা বিশাল অট্টালিকা আরও কত কি; যা মানুষের জীবনে আনে গতিশীলতা, এগিয়ে নিয়ে যায় দেশ ও সভ্যতাকে। এই অধ্যবসায়ে সামান্যতম ত্রুটি থাকলে ধসে পড়বে বিশাল অট্টালিকা, থেমে যাবে কল-কারখানার চাকা, বাড়বে উৎপাদন ব্যয়, বিপর্যয় ঘটবে পরিবেশের। ফলে লণ্ডভণ্ড হবে আমাদের আধুনিক জীবন ও সভ্যতা। ঠিক একই চিত্র ডাক্তারদের বেলায়। সামান্যতম ত্রুটিতে ঘটতে পারে একটি সম্ভাবনাময় জীবনের অকালপ্রয়াণ।

অন্যদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চিত্র কিছুটা ভিন্ন। সেখানকার পড়াশোনাটা বুয়েট বা মেডিকেলের মতো অতটা বিশেষায়িত নয়। বেশিরভাগই তত্ত্বীয়-নির্ভর শিক্ষা। তাই শিক্ষার্থীরা শিক্ষাজীবনে পড়াশোনার বাইরে অন্য জগতে সময় দেওয়ার মতো কিছুটা ফুরসত পায়। তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের পেশাজীবনও এতটা নির্দিষ্ট নয়। বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, বিজ্ঞানের ছাত্র পুলিশে, আইনের ছাত্র প্রশাসন বা ফিন্যান্সের ছাত্র মার্কেটিংয়ের পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। বুয়েট বা মেডিকেলের ক্ষেত্রে তাদের পেশাগত জীবন অনেকটাই নির্ধারিত বলা চলে। এখন আমলা পেশা অত্যন্ত আকর্ষণীয় হওয়ায় মেধাবী প্রকৌশলীরা কিংবা ডাক্তাররাও এ পেশায় ঝুঁকছেন।

সাধারণত বুয়েট থেকে পাস করে অধিকাংশ প্রকৌশলীই পাড়ি দেন আমেরিকা, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায়। পড়াশোনা শেষে কাজ করেন ইন্টেল, টেক্সাস ইন্সট্রুমেন্ট, জেনারেল মোটরস, ফোর্ড, গুগল, মাইক্রোসফট, ফেসবুক, বোয়িং ইত্যাদি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে। যারা দেশে থাকেন তারা জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাট, আবাসন, স্যাটেলাইট ইত্যাদি সেক্টরে কাজ করে থাকেন। আমার বুঝে আসছে না, এ ধরনের মেধাবী শিক্ষার্থীরা কী কারণে লেজুড়বৃত্তি করা রাজনীতিতে জড়িয়ে নিজের, পরিবারের ও জাতির চাওয়াটাকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করেন? তাদের জানা দরকার, এ পর্যন্ত কতজন প্রকৌশলী রাজনীতি করে সংসদ সদস্য কিংবা মন্ত্রী হয়েছেন। আমার জানা মতে, রাজনীতি করে প্রকৌশলী থেকে মন্ত্রী হয়েছেন গুটিকয়েকজন। সংসদ সদস্য হয়েছেন হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র। তাও তারা তৃণমূল থেকে মূলধারার সক্রিয় রাজনীতি করে এসেছেন এমনটি নয়। বস্তুতপক্ষে রাজনৈতিক বড় ভাইয়েরা প্রত্যন্ত অঞ্চলের এসব মেধাবী সহজ-সরল ছেলেকে মগজ ধোলাই দিয়ে এ পথে নামিয়েছে।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বুয়েট থেকে পাস করা সব প্রকৌশলী তাদের পেশাগত জীবনে প্রায় শতভাগই সফল হয়ে থাকেন। সফলতার পেছনে রয়েছে আকাশচুম্বী স্বপ্ন দেখা। আবরার হত্যায় অভিযুক্ত ১৯ জন ছাত্রও স্বপ্ন দেখেছিল সফল হওয়ার। স্বপ্ন দেখেছিল তাদের পরিবার। স্বপ্ন দেখেছিল বলেই শিক্ষাজীবনের প্রতিটি স্তরে তারা কঠিন অধ্যবসায়ের মাধ্যমে অনেক বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে বুয়েটে ভর্তি হয়েছিল। তারা যদি আগে থেকে রাজনীতি কিংবা এ ধরনের বিষয়ে সম্পৃক্ত থাকত, তাহলে বুয়েটে কখনও ভর্তি হতে পারত না। তাহলে বিষয়টা স্পষ্ট যে, অভিযুক্তরা অসুস্থ রাজনীতিতে প্রবেশ করে অনৈতিক চর্চার অভ্যাসটা অত্যন্ত সফলভাবে করেছে বুয়েট জীবনের ২-৩ বছরের মধ্যেই। আমাদের সময়ে প্রশাসন যেমন সবকিছু কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করত, আবার স্নেহেও রাখত। কিন্তু আজ বুয়েট প্রশাসনের নির্লিপ্ততায় অত্যন্ত সম্ভাবনাময় আবরারের জীবনপ্রদীপ অকালেই নিভে গেল। অভিযুক্ত ১৯ জন মেধাবী শিক্ষার্থী যোগ্য প্রকৌশলী না হয়ে হয়েছে দানব। এখন দেখছি, এ দানবদের অত্যাচারে অনেকেই পঙ্গুত্ববরণ করেছে, মানসিক রোগী হয়েছে। তাদের পক্ষে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, সুস্থ জীবনযাপন করা আজ দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বুয়েটের মতো জায়গায় এ দানবরা দিনের পর দিন এ বর্বরোচিত ও অমানবিক কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছিল আর প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে কেন নীরব থেকেছে, তা কোনোক্রমেই আমাদের বোধগম্য নয়। আমার মনে হয়, রাজনৈতিক কিংবা অন্য কোনো কারণে উপাচার্যের সঙ্গে শিক্ষকদের বিশাল দূরত্ব বিরাজমান। যার কারণে বিরাজমান সমস্যা সমাধানে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এমনিতেই বুয়েটে শিক্ষকদের সঙ্গে ছাত্রদের দূরত্ব চিরকাল থেকেই। তাহলে বুয়েটে এ দানব তৈরির দায়ভার কে নেবে? বুয়েট প্রতিষ্ঠাকালীন প্রথম উপাচার্য এমএ রশীদ স্যারের আদর্শ দিয়ে তিলে তিলে গড়া জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রথিতযশা প্রতিষ্ঠানটির সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখার দায়িত্ব কে নেবে? কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি ভেবে দেখার অনুরোধ রইল।

দেশ আজ নিম্নমধ্যম আয় থেকে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে কারা? মেধাবীরা এগিয়ে না এলে আমাদের হোঁচট খেতে হবে প্রতিটি স্তরে। এসব মেধাবীকে স্বপ্ন দেখতে হবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার। তাদের আত্মনিয়োগ করতে হবে কীভাবে আধুনিক প্রযুক্তি-সমৃদ্ধ আবাসন তৈরি, পরিবহন, রাস্তাঘাট নির্মাণ, জ্বালানি সাশ্রয়ী সমৃদ্ধ পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। পরমাণু প্রযুক্তি ব্যবহার, স্যাটেলাইট, মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার, রোবট ইত্যাদি ব্যবহারে উচ্চ প্রযুক্তিঘন বাংলাদেশ বিনির্মাণ। যে যাই বলুক, পেশাজীবী তৈরি বিশেষায়িত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনীতি আর দেখতে চাই না। রাষ্ট্র তাদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

চেয়ারম্যান, নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েট অ্যালামনাই

পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন কলেজ পরিচালনা পর্ষদ থেকে ঘুষে অভিযুক্ত সাংবাদিককে বাদ দেওয়ার দাবি - dainik shiksha কলেজ পরিচালনা পর্ষদ থেকে ঘুষে অভিযুক্ত সাংবাদিককে বাদ দেওয়ার দাবি পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0051939487457275