মহামান্য রাষ্ট্রপতি সম্প্রতি বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে উচ্চশিক্ষা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে উপাচার্য, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ভূমিকা ও করণীয় নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, যা উচ্চশিক্ষার মানের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। উচ্চশিক্ষা মানের পূর্বশর্ত মানসম্মত শিক্ষক, উন্নত গবেষণা, মানসম্পন্ন অবকাঠামো ও এ সঙ্গে যুক্ত আরো অনেক বিষয়। যদি এগুলো নিশ্চিত করা সম্ভব না হয় তাহলে শিক্ষা শুধু সার্টিফিকেটসর্বস্ব বলে গণ্য হতে বাধ্য। বর্তমানে আমাদের উচ্চশিক্ষা কোনোভাবেই সংকুচিত নয়। এর দ্বার রুদ্ধ নয়; বরং অবারিত। সহজভাবে বলতে গেলে হাতের নাগালে। একজন শিক্ষার্থী যদি চান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করবেন, তাঁর পক্ষে অসম্ভব নয়। উচ্চশিক্ষায় আকৃষ্ট করার জন্য ভর্তি মেলার আয়োজনও করা হয়। উচ্চশিক্ষা প্রতিযোগিতামূলক তবে তা নির্দিষ্ট কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ফলে বরাবরই মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষার প্রশ্ন রয়ে যায়। ১৯৯০-৯১ শিক্ষাবর্ষ থেকে খুলনা ও শাবিপ্রবি শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করার আগে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল খুবই কম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারা ছিল ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু মাত্র তিন দশকের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস করার পর এবং সরকারিভাবে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মধ্য দিয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে ৪৬টি চালু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং চারটি অনুমোদনসহ মোট ৫০টি এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০০টির বেশি। পাল্লা দিয়ে তৈরি হচ্ছে সরকারি ও বেসরকারি অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আমাদের কাছে মনে হয় জনসংখ্যা অনুপাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেশি নয় কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ধরন ও মানের মধ্যে ফারাক অনেক বেশি। প্রয়োজনমাফিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব আমরা অনুভব করছি। আমরা প্রতিবছর প্রচুর গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছি কিন্তু শিক্ষাকে কাজে লাগানোর মতো বড় ক্ষেত্র তৈরি করতে পারছি না। আবার কাজে লাগানোর মতো মানও তৈরি করতে আমরা সফল নই। উচ্চশিক্ষা অনেকটা শিক্ষিত বেকার তৈরির কারখানায় পরিণত হচ্ছে। সোমবার (২০ জানুয়ারি) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, উচ্চশিক্ষার জন্য বড় অংশ পড়াশোনা করছে দেশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। সরকারের নীতির অংশ হিসেবে জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ অব্যাহত আছে। কিন্তু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুণগত মানের শিক্ষা দেওয়ার ইচ্ছা পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এক দিনে কিংবা রাতারাতি মান উন্নয়ন সম্ভব নয়। কিন্তু এমন কী কী উদ্যোগ আমাদের চোখে পড়ে, যার ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি আগামী ২০ কিংবা ৩০ বছর পর আমাদের শিক্ষা এই জায়গায় পৌঁছাবে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন শিক্ষার শর্ত সন্দেহ নেই কিন্তু মানসম্মত শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের গবেষণার সুযোগ ও অর্থের জোগান বেশি না হলে মানসম্মত শিক্ষা দেওয়া সম্ভব হয় না।
শিক্ষার মূল বিষয় যখন এর সঙ্গে যুক্ত সুযোগ-সুবিধা আর এর কাণ্ডারি হিসেবে যাঁকে মনে করা হয়, তিনি শিক্ষক। আর প্রশাসক হিসেবে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যিনি থাকেন তিনি উপাচার্য। আমাদের পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মানসম্মত শিক্ষক রয়েছেন কিন্তু নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন শিক্ষক সংকট রয়েছে তেমনি সিনিয়র শিক্ষকদের ঘাটতি আরো প্রকট। মানসম্মত শিক্ষক পাওয়া কতটুকু সম্ভব তা প্রশ্নের সম্মুখীন। উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়া শিক্ষক পাওয়া একেবারেই দুষ্কর। অপেক্ষাকৃত নবীন শিক্ষকদের নিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক দক্ষতার অভাব এবং নতুন পুরাতন জ্ঞানের মধ্যে বিচরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আরো বড় সমস্যা যিনি নবীন তাঁর উচ্চশিক্ষার সুযোগ সরকারিভাবে নগণ্য। মালয়েশিয়াসহ এশিয়ার অনেক দেশের শিক্ষার্থীরা সরকারি অর্থে অনেক আগে থেকে বিদেশে পড়াশোনা করে দেশে এসে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কাজে করছেন। আমরা উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারণ করছি কিন্তু উচ্চশিক্ষাকে মানসম্মত করার জন্য শিক্ষকদের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদানের সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছি না। আমাদের উচ্চশিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ আছে কিন্তু প্রয়োজন মাফিক কি না তা ভাবছি না।
উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারণে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনই বড় বিষয় নয়। উচ্চতর জ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষকদের প্রয়োজনে বিশেষ প্রণোদনা দিয়ে কিংবা প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিয়োগ দিয়ে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তৈরি করতে হবে। নবীন শিক্ষকদের বৃত্তি দিয়ে ভালো দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। যাঁদের জ্ঞান অন্বেষণ ও গবেষণায় আগ্রহ রয়েছে তাঁদের বাছাই করা। আঞ্চলিকতাসহ দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তৈরি করতে হবে। এগুলো যেন বিশ্বের একটি বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গড়ে ওঠে।
লেখক : ড. নিয়াজ আহম্মেদ, অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।