মানসম্মত শিক্ষার অন্তরায় কোথায়? - দৈনিকশিক্ষা

মানসম্মত শিক্ষার অন্তরায় কোথায়?

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষকে সুন্দরভাবে ভাবতে শেখানো, মানবীয় গুণাবলির উন্নয়ন ঘটানো এবং কর্মক্ষেত্রে দক্ষ জনবল তৈরি। এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, সততা এবং শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা অপরিহার্য। ম্যানেজমেন্টের দৃষ্টিকোণ থেকে শুধু শিক্ষা নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সফলতা প্রাপ্তির চেষ্টার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সময়কালকে আমরা চারটি বিশেষ ধাপে ভাগ করতে পারি। ধাপগুলি হলো : ফরমিং (Forming), স্টরমিং (Storming), নরমিং (Norming) ও পারফরমিং (Performing)। মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিথ এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। 

নিবন্ধে আরও জানা যায়, যে কোনো বয়সে, যে কোনো ধাপে শিক্ষার নিমিত্তে শুরুতে যে আয়োজন তাকে আমরা ফরমিং ধাপ হিসেবে অভিহিত করছি। একজন শিক্ষার্থী যখন শিক্ষার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয় তখন তার সঙ্গে শিক্ষক, বই, প্রতিষ্ঠানের ভৌত অবকাঠামো, সহপাঠীর সঙ্গে সর্বজনীন জ্ঞান অর্জনে প্রারম্ভিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এই পর্যায়কে আমরা ফরমিং ফেজ (Forming Phase) বলতে পারি। এর পরের ধাপটি হলো স্টরমিং। কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সততার সঙ্গে অনুশীলন দরকার। এই ধাপটি সুশিক্ষিত ও দক্ষ নাগরিক তৈরির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এই পর্যায়টি যত বেশি সত্ ও স্বচ্ছ হবে শিক্ষাও ততটাই মানসম্মত হবে। স্টরমিং ফেজে শিক্ষার্থীর মধ্যে জানার আগ্রহ এবং শিক্ষকের মধ্যে জানানোর আগ্রহ থাকতে হবে প্রবল। ক্লাস ও পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করে সার্টিফিকেটনির্ভর ডিগ্রি পাওয়া বা ব্যাবসায়িক কারণে সার্টিফিকেটনির্ভর ডিগ্রি দেওয়ার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পড়াশোনার সুন্দর পরিবেশ, ছাত্র-শিক্ষক সুসম্পর্ক, বোঝানো ও বোঝার চেষ্টা যদি আন্তরিক হয়, তাহলে এই ধাপের সুন্দর পরিসমাপ্তি ঘটবে। কিন্তু ধারণক্ষমতার চাইতে অতিরিক্ত ছাত্র, শিক্ষকের স্বল্পতা ইত্যাদি এই পর্যায়কে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে। এর পরবর্তী ধাপই হলো জ্ঞানের স্বাভাবিকতা ও পরিপূর্ণতা। যাকে নরমিং ফেজ হিসেবে অভিহিত করা যায়। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে জ্ঞানের স্বাভাবিকতা ও পরিপূর্ণতা বয়স অনুযায়ী ভিন্ন হয়। এ পর্যায়ে জ্ঞানের সাবলীল প্রয়োগের জন্য প্রস্তুত থাকে শিক্ষার্থীরা। তারা হয়ে ওঠে প্রত্যয়ী। নরমিং ধাপটি পরিপূর্ণ হলে পারফরমিং ধাপটি পূর্ণরূপে কার্যকরী হয়। ফলে পরিপক্ব জ্ঞানের অধিকারী জনবল তাদের ওপর অর্পিত কাজের সফল পরিসমাপ্তি ঘটায়।

উন্নত বিশ্বের আদলে বহুবার আমাদের স্কুল, কলেজের শিক্ষাব্যবস্থাকে কাটা-ছেঁড়া করা হয়েছে। কখনো বহুনির্বাচনী প্রশ্ন, কখনো সৃজনশীল। কিন্তু কোনটি যে আমাদের জনসংখ্যা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক উন্নয়নের জন্যে বেশি কার্যকরী তা কখনোই পরিমাপ করা সম্ভব হয়নি। তবে স্কুল, কলেজের অভিজ্ঞ শিক্ষকগণের হতাশার বাণী থেকেই বোঝা যায় যে, বর্তমান পদ্ধতিতে তারা মোটেও সন্তুষ্ট নন। আমার ছেলে দশম শ্রেণিতে পড়ে। তাকে কোনো বিষয় বই থেকে হুবহু পড়ানো যায় না। তার কথা বইয়ের মতো করে তো প্রশ্ন পরীক্ষায় আসবে না। প্রশ্ন হবে সৃজনশীল। ফলে পরীক্ষার খাতায় বেঁধে দেওয়া তিন ঘণ্টা সময়ের মধ্যে নিজের মতো করে লিখতে গিয়ে খাতায় লেখার নিপুণতার বড়ো অভাব পরিলক্ষিত হয়। সৃজনশীল প্রশ্নের সহায়ক হিসেবে অসংখ্য গাইড বই বের হয়েছে এবং গাইডগুলো ছাত্র-শিক্ষক উভয়ই ব্যবহার করছে সমান হারে। ফলে মূল বই পড়া ব্যাহত হচ্ছে। ঘাটতি থেকে যাচ্ছে বিভিন্ন শ্রেণির ধাপভিত্তিক জ্ঞানের। সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রকাশভঙ্গি হচ্ছে স্কুলের ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ প্রতিযোগিতার আদলে ‘যেমন খুশি তেমন লেখো’ প্রক্রিয়ায়। অথচ ব্রিটিশ দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকন বলেছিলেন, ‘কিছু বই আস্বাদনের জন্য, কিছু বই তথ্য গলাধঃকরণের জন্য, আর কিছু বই চিবানো ও হজম করার জন্য।’ সে সময় জ্ঞান অর্জনের দর্শনটি এমন ছিল বলেই ইংরেজরা জ্ঞানের মাপকাঠিতে ছিল শ্রেষ্ঠ।

সম্প্রতি আমার সাবজেক্টে মাস্টার্স শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নিলাম। পরীক্ষায় পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিটে। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম শিক্ষার্থীরা ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিট লেখার পরেই লেখার কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। আমি তাদেরকে জিগ্যেস করলাম, ‘পড়োনি নাকি?’ একজন অকপটে বলল, ‘স্যার, পড়ি কিন্তু ১০ মিনিট পড়ার পরই মনে হয় মোবাইলে কোনো নোটিফিকেশন এলো কি না দেখি। মোবাইলটা হাতে নিয়ে নিজের অজান্তেই হারিয়ে যাই একের পর এক লিংকে। কখন যে অনেকখানি সময় নষ্ট হয়ে যায়, বুঝতেই পারি না।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স পড়ুয়া শিক্ষার্থীর যদি ভার্চুয়াল দুনিয়ার প্রতি এই পরিমাণ আসক্তি থাকে তাহলে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরো ভয়াবহ হওয়ার কথা। আরো একটি বিষয় তিক্ত হলেও সত্য, শিক্ষকদের মধ্যেও এই আসক্তির মাত্রা ছাড়িয়েছে। ফলে শিক্ষা নিয়ে অনুশীলনের সময় থাকছে না।

আমরা প্রায়ই বলি মুখস্থ বিদ্যা ভয়ংকর। কিন্তু মনে রাখা ও অনুশীলন ছাড়া কি কোনো কিছুর উত্তর দেওয়া সম্ভব? পদার্থ, রসায়ন, গণিত ইত্যাদির সূত্র, বিক্রিয়া মনে না রেখে কি সেটা লেখা সম্ভব? অঙ্ক শুধু বুঝলেই হবে না, পরীক্ষার খাতায় নির্ভুলভাবে করার জন্য অনুশীলন অত্যন্ত জরুরি, জ্যামিতির অনুসিদ্ধান্ত মনে না রেখে অনুশীলনীর সমস্যা কি সমাধান করা সম্ভব? কিন্তু এমন অবস্থা হয়েছে যে, এই বিষয়গুলোও শিক্ষার্থীরা মনে রাখতে চায় না, তাদের মতো করে লিখতে চায়।

সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যা তৈরি হয়েছে লেখার দক্ষতা নিয়ে। সবকিছু স্মার্টফোনের মাধ্যমে ছবি তুলে রাখতে গিয়ে লেখার ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। ফলে লেখা যেমন অসুন্দর হচ্ছে তেমনি হচ্ছে ভুলে ভরা। তাই আমার ব্যক্তিগত মতামত স্কুল-কলেজে অবশ্যই একটি অতিরিক্ত শ্রুতিলিখন (ডিকটেশন) ক্লাস লেখার জন্য চালু করতে হবে। অনুশীলনে সময় না দিলে নির্ভুল ও সুন্দরভাবে লেখা সম্ভব নয়। ফলে পরীক্ষাভীতি থাকবেই এবং ঐ ভীতি থেকেই তৈরি হবে মানসিক উত্কণ্ঠা। ১৩ নভেম্বর ২০১৯ একটি জাতীয় পত্রিকার খবরের শিরোনাম ‘পরীক্ষার মানসিক চাপ কমাতে কবরে শুয়ে থাকার পরামর্শ’। খবরে প্রকাশ, শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার আগে মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পেতে অভিনব পরামর্শ দিয়েছে নেদারল্যান্ডসের র্যাডবউড বিশ্ববিদ্যালয়। নেদারল্যান্ডসের নিজমেগেন শহরের এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ কমাতে তাদেরকে কবরে শুয়ে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। এই পদ্ধতিতে কবরের মতো গর্তে শুয়ে থাকতে হয়। একজন শিক্ষার্থী সর্বনিম্ন ৩০ মিনিট থেকে সর্বোচ্চ তিন ঘণ্টা পর্যন্ত সময় কাটাতে পারবেন এই কবরে। শিক্ষা শুরুর আদি থেকেই পরীক্ষার বিষয়টি ছিল। সেই চাপ কমাতে এ পর্যন্ত কাউকে কবরে শুতে হয়নি। এখন কেন হচ্ছে? ধনী দেশগুলির কথা না-ই বললাম। কারণ তাদের নাগরিকদের অর্থনৈতিক সুরক্ষা আছে। কিন্তু আমার দেশে মানসম্মত শিক্ষাই উন্নয়নের প্রধান নিয়ামক। তাই শিক্ষার উত্কর্ষসাধনে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করা আপনার আমার সবার দায়িত্ব।

লেখক : ড. মো. নাছিম আখতার, অধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.015591144561768