মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রধান মাধ্যম শিক্ষা। মানসম্মত শিক্ষা দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরিতে সহায়তা করে। আমরা প্রায়ই বিভিন্ন বক্তব্যে মানসম্মত শিক্ষার কথা বলি। তথ্য মতে, মানসম্মত শিক্ষা এমন একটি শিক্ষা যা মানুষের সম্ভাবনাময় বৈশিষ্ট্য ও দক্ষতাকে বিকশিত করে। মানসম্মত শিক্ষাপ্রত্যয়ী জনগোষ্ঠী তৈরি করে। প্রত্যয়ী জনগোষ্ঠী হবে বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, সাহিত্য বিষয়ে পারদর্শী এবং যাদের থাকবে কোনো অজানা বিষয়ে শেখার জন্য প্রত্যয় বা হার না মানা মনোভাব। প্রত্যয়ী শিক্ষার্থী তৈরির জন্য ভিত্তিজ্ঞানের ওপর জোর দিতে হবে। শক্তিশালী ভিত্তিজ্ঞানের অধিকারী শিক্ষার্থী যেকোনো অজানা বিষয়ে মনঃসংযোগ করলেই সে সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পারবে।
সম্প্রতি ‘শিক্ষার মান ঠিক করতে হবে’ শিরোনামে জাতীয় দৈনিকে একটি খবর প্রকাশিত হয়। খবরে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বিজ্ঞান, তথ্য-প্রযুক্তি, গবেষণা, ভাষা ও গণিতে মনোযোগ বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাই শিক্ষার মান উন্নয়নে ভবিষ্যতে কিভাবে এগিয়ে যেতে হবে তার একটি কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ আবশ্যক। এ লক্ষ্যে প্রথমে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার শক্তিশালী ও দুর্বল দিকগুলো খুঁজে বের করা দরকার। শক্তিশালী দিকগুলোকে আমরা গ্রহণ করব আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে। আর দুর্বল দিকগুলো বিশ্লেষণের মাধ্যমে মানসম্মত শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে দুর্বলতা কাটিয়ে উঠব।
তিন বছর আগে একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে গিয়ে এক বড় ভাইয়ের বিদেশিনী সহধর্মিণীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আমাদের এই জনাকীর্ণ দেশে ৩০ বছর কাটিয়ে দিলেন, কেমন লাগছে এই দেশ?’ তিনি বলেছিলেন, ‘গরম একটু বেশি, তা ছাড়া সবই আমি উপভোগ করেছি।’ তাঁর ভাষায় অনেক লোক হওয়ায় এ দেশ যেকোনো বিষয়ের জন্য ভালো প্রশিক্ষণ ক্ষেত্র। এ দেশের পড়াশোনা ও চাকরি ক্ষেত্রে ভীষণ প্রতিযোগিতায় অভ্যস্ত মানুষ পৃথিবীর কোথাও ঠেকবে না। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, তাঁর দুই ছেলে-মেয়ের মধ্যে ছেলে আমেরিকার একটি ভালো মানের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মেয়ে মালয়েশিয়ার একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বিপুল জনসংখ্যার কারণে প্রতিযোগিতাময় যে ক্ষেত্র সেখানে সফল হওয়ার জন্য সুষুম প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে পারলেই যে দক্ষ জনশক্তি বেরিয়ে আসবে তারা প্রত্যেকেই হবে দিগ্বিজয়ী।
পারিবারিক বন্ধনের দৃঢ়তার ক্ষেত্রে আমাদের দেশ পৃথিবীর অনেক দেশের অন্যতম। ভূমিষ্ঠ হওয়া থেকে স্কুলে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত কোনো শিশু সব কিছুই শিখে তার পরিবার ও সামাজিক পরিমণ্ডল থেকে। সুন্দর পারিবারিক পরিমণ্ডলে থেকে যে শিশু-কিশোর বেড়ে ওঠে তাদের বেশির ভাগেরই চিন্তা-চেতনা হয় সুস্থ ও স্বাভাবিক। এই সুস্থ ও স্বাভাবিক জনগোষ্ঠীকে যেকোনো শিক্ষায় শিক্ষিত করা অনেকটাই সহজ। তাই আমাদের দেশ থেকে মানসম্মত শিক্ষায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরি করা অনেক সহজ বলে আমি মনে করি।
দুর্বল দিকগুলোর মধ্যে প্রথমটি হলো যথাসময়ে সিলেবাস শেষ না করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমার ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা থেকে আমি সর্বদাই আমার বিষয়ে সেমিস্টার সিলেবাস শেষ করার চেষ্টা করে যাই। একুশ বছরের চাকরি জীবনে বিষয়টিতে সব সময়ই সফল হয়েছি। সর্বমোট ১৩ সপ্তাহের ৩৯টি ক্লাসে যদি আমরা ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের সিলেবাস শেষ করতে পারি, তাহলে স্কুল ও কলেজে ৫২ সপ্তাহে কেন সিলেবাস শেষ হয় না? এর কারণ অনুসন্ধানে সর্বপ্রথম গুরুত্ব দিতে হবে। স্কুল ও কলেজপর্যায়ে সিলেবাস শেষ করার বিষয়ে শিক্ষকদের উদাসীনতা পরিলক্ষিত হয়। ক্লাস নেওয়ার আগে আজ কী পড়াব, কতটুকু পড়াব এর লেকচার প্ল্যান শিক্ষকের কাছে থাকা উচিত। কিন্তু এমন কিছুই দেখা যায় না। সুতরাং এ বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে।
ব্যাবহারিক ক্লাসের বিষয়ে শিক্ষকদের উদাসীনতা রয়েছে। অনেক ভালো স্কুলে পদার্থ, রসায়ন, জীববিজ্ঞানের বিষয়ে ব্যাবহারিক ক্লাস হয় না। এ বিষয়ে মনিটরিং দরকার। কারণ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ব্যাবহারিক বিষয়গুলো সম্পর্কে হাতে-কলমে জ্ঞানার্জন শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় উৎসাহী করে এবং তাদের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতার জন্ম দেয়। সুতরাং বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে ব্যাবহারিক ক্লাস নিয়মিতকরণ বাঞ্ছনীয়। এটিও মানসম্মত শিক্ষা বিস্তারে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
আমার ছেলে-মেয়ে দুজনই স্কুলে পড়ে। একজন দশম শ্রেণি, আরেকজন ষষ্ঠ শ্রেণি। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত আমি নিজেই ছেলেকে পড়িয়েছি। তাই স্কুলশিক্ষাকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। সৃজনশীলের নামে চলছে ছাত্রদের অলস করার মহোৎসব। সৃজনশীলে তাই কোনো কিছু মুখস্থ করা বা হৃদয়াঙ্গমের দরকার নেই। শুধু রিডিং পড়লেই হবে। ফলে পড়ার প্রতি যে আত্মনিয়োগ তা বহুলাংশে কমে যাচ্ছে। আর সৃজনশীল প্রশ্ন ও উত্তর কী হবে তা পেতে গাইড বইয়ের কোনো বিকল্প আমি এখনো পর্যন্ত দেখছি না। কী শিক্ষক, কী ছাত্র সবার কাছে রয়েছে বিভিন্ন চটকদার নামের গাইড বইয়ের সংগ্রহশালা। এগুলো থেকেই সাধারণত প্রশ্ন করা হয়। তাই সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে আরো বিচার-বিশ্লেষণ দরকার আছে বলে আমি মনে করি।
স্মার্টফোনের বিনোদন জগৎ শিক্ষার্থীদের মনঃসযোগ কমায় ও পড়ালেখার মূল্যবান সময় নষ্ট করে। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে উন্নত দেশগুলোর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা উচিত। গত আগস্ট মাসেই স্কুলে স্মার্টফোন নিষিদ্ধ করেছে ফ্রান্স। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মনোযোগী করে তুলতেই এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্য সরকার কলেজ ক্যাম্পাসে স্মার্টফোন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। আমেরিকার স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউ জার্সি দুই বছর ধরে দুই হাজার ৬০০ স্কুলছাত্রের ওপর একটি গবেষণা সমীক্ষা চালায়। গবেষণায় দেখা গেছে, স্মার্টফোন বা ডিভাইসে যারা দীর্ঘ সময় কাটায় তাদের মনোযোগের মারাত্মক ঘাটতি দেখা দেয়। যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ADHD (Attention Deficit Hyperactivity Disorder) বলে। এ ছাড়া ছাত্রসমাজের ইন্টারনেট ব্যবহার ইতিবাচক ব্যবহারে পরিণত করতে হবে।
জনসংখ্যার কারণে প্রতিযোগিতাময় সামাজিক পরিমণ্ডল আমাদের জীবনের অংশ। ভর্তি, চাকরি, সব ক্ষেত্রেই রয়েছে ভীষণ প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় আমাদের সন্তানরা যাতে মানসিকভাবে ভেঙে না পড়ে সে জন্য চাই তাদের সুস্থ ও সবল স্বাস্থ্য রক্ষার প্রয়াস। কিন্তু বর্তমান যুগে জীবনযাত্রার পরিবর্তনের কারণে শিশু-কিশোরদের খেলাধুলা আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। বিকেল হলেও তারা মাঠে খেলতে না গিয়ে স্মার্টফোনে বিভিন্ন মুভি দেখছে অথবা গেম খেলছে। ফলে তারা স্থূলকায় হয়ে পড়ছে। কমছে মানসিক চাপ নেওয়ার ক্ষমতা। মানুষের দেহের চালিকাশক্তি হলো হরমোন। এর মধ্যে সুখের হরমোন নামে পরিচিত অক্সিটোসিন, সেরোটনিন, এন্ডোরফিন—এগুলোর সঠিক মাত্রা বজায় রাখতে প্রতিদিন গড়ে ২০ থেকে ৩০ মিনিট ব্যায়াম করা উচিত। এ ছাড়া বাচ্চাদের জন্য খেলাধুলা বা সাঁতার কাটার ব্যবস্থা থাকা উচিত। প্রতিটি স্কুল-কলেজে ব্যায়াম, খেলাধুলা ও সাঁতার কাটার উপযুক্ত ব্যবস্থা থাকতে হবে।
দেশে মানসম্মত শিক্ষা বিস্তারের শক্তিশালী ও দুর্বল দিকগুলো উন্মোচন আমাদের সুস্থ দেহ, প্রশান্ত মন ও কর্মোদ্দীপনাময় আত্মপ্রত্যয়ী নবপ্রজন্ম তৈরির পথ দেখাবে বলে আমার বিশ্বাস।
লেখক : অধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ