সুন্দরবন মহিলা কলেজ। বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার এ কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় এক হাজার। নিয়মিত পাঠদানের সুবিধার্থে কলেজে একটি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম (এমএমসি) স্থাপন করেছে সরকার। কলেজের নিজস্ব অর্থায়নে যুক্ত করা হয়েছে আরো একটি এমএমসি। তবে এ কলেজে কর্মরত ৩৫ জন শিক্ষকের মধ্যে অধ্যক্ষ ছাড়া অন্য কেউ ডিজিটাল কন্টেন্ট তৈরি করতে পারেন না। এ কারণে হাতেগোনা দু-একটি বিষয় ছাড়া বেশির ভাগ ক্লাসই নেয়া হচ্ছে সনাতন পদ্ধতিতে। ফলে অব্যবহৃত থাকছে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম। আজ সোমবার(১৮ মার্চ) বণিক বার্তায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন সাইফ সুজন
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, শুধু সুন্দরবন মহিলা কলেজ নয়; দেশের অন্য কলেজগুলোয় পাঠদানরত অধিকাংশ শিক্ষকই ডিজিটাল কন্টেন্ট তৈরিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠদানরত শিক্ষকদের ডিজিটাল কন্টেন্ট তৈরির দক্ষতা নিরূপণে গত বছর ফরিদপুরের বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গবেষণা চালায় জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম)। গবেষণার অংশ হিসেবে ৯০ জন শিক্ষার্থী ও ২৭ জন শিক্ষকের সাক্ষাত্কার গ্রহণ এবং ২৭টি ক্লাস পর্যবেক্ষণ করা হয়। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সম্প্রতি ‘ডিজিটাল কন্টেন্ট ইন হায়ার সেকেন্ডারি এডুকেশন ইন বাংলাদেশ: পসিবিলিটিজ অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে নায়েম।
প্রতিবেদন অনুযায়ী মাত্র ১১ শতাংশ শিক্ষক ডিজিটাল কন্টেন্ট তৈরিতে দক্ষ। এক্ষেত্রে ৩৩ শতাংশ শিক্ষকের দক্ষতা মোটামুটি। আর ৫৬ শতাংশ শিক্ষকই ডিজিটাল কন্টেন্ট তৈরিতে দুর্বল। গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়, অধিকাংশ শিক্ষকই বলেছেন, তারা ডিজিটাল কন্টেন্ট তৈরি করেন না। বর্তমানে তারা পুরনো পদ্ধতিতে ক্লাস নিচ্ছেন এবং এ পদ্ধতিতেই স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন। ক্লাস পর্যবেক্ষণেও একই চিত্র উঠে এসেছে। শিক্ষকরা শুধু ডিজিটাল কন্টেন্ট তৈরিতে অদক্ষ তা নয়; মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের যন্ত্রপাতিগুলোও তারা ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারেন না। অল্প যে কয়েকজন শিক্ষক ডিজিটাল কন্টেন্টে পাঠদান করেন, তাদের বেশির ভাগই কন্টেন্ট তৈরির চেয়ে শিক্ষক বাতায়ন পোর্টাল থেকে ডাউনলোড করতে পছন্দ করেন।
এ বিষয়ে সুন্দরবন মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ শেখ খালিদ আহমেদ বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানের ৩৫ জন শিক্ষকের কেউই ডিজিটাল কন্টেন্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ পাননি। আমি কয়েক দিন আগে এ বিষয়ে ছয়দিনের একটি প্রশিক্ষণ নিয়েছি। এরপর বুঝলাম মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ব্যবহারের ক্ষেত্রে ডিজিটাল কন্টেন্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। এখন আমাদের আইসিটি শিক্ষককে পাঠাব। এরপর ক্রমান্বয়ে অন্যদের পাঠানো হবে। সত্যি বলতে, প্রশিক্ষণ না থাকায় আমাদের প্রায় সব শিক্ষক প্রচলিত নিয়মেই ক্লাস নিচ্ছেন। শুধু আইসিটির কয়েকটি ক্লাস এমএমসিতে নেয়া হয়।’
এদিকে ডিজিটাল কন্টেন্ট তৈরি করতে না পারলে শিক্ষক বাতায়ন থেকে কন্টেন্ট সংগ্রহ করেও পাঠদানের সুযোগ রয়েছে। তবে সেটিও করছেন না শিক্ষকরা। নায়েমের গবেষণায় অংশ নেয়া শিক্ষকদের ৮৫ শতাংশ এখনো শিক্ষক বাতায়নের সদস্য হননি। আর শিক্ষক বাতায়নে লগ-ইন করেননি ৯১ শতাংশ শিক্ষক। এর অর্থ, যে ১৫ শতাংশ শিক্ষক এ পোর্টালের সদস্য হয়েছেন, তাদের সবাই লগ-ইন করেননি।
অন্যদিকে ডিজিটাল কন্টেন্ট তৈরি করতে না পারায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের যন্ত্রপাতিগুলোও অব্যবহৃত থাকছে। গবেষণার আওতাভুক্ত ৯৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠানেই এমএমসি যন্ত্রপাতি অব্যবহৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে।
নায়েমের প্রতিবেদনে ক্লাসরুমে ডিজিটাল কন্টেন্ট ব্যবহারের ক্ষেত্রে কয়েকটি চ্যালেঞ্জ তুলে ধরা হয়েছে। এগুলো হলো প্রশিক্ষণ না থাকা, অবকাঠামোর অভাব, শিক্ষকদের অনাগ্রহ।
মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম প্রতিষ্ঠার আগে ডিজিটাল কন্টেন্ট বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী। তিনি বলেন, কম্পিউটার কিংবা প্রজেক্টর প্রদানের লক্ষ্য ছিল এসব ডিভাইসের মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা, যাতে তাদের কাছে পাঠ আরো আনন্দদায়ক ও আকর্ষণীয় হয়। কিন্তু দেখা গেছে, দেশের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে যন্ত্রপাতি পাঠানো হলো। এখন শিক্ষকরা কন্টেন্টই তৈরি করতে পারছেন না। আসলে তথ্যপ্রযুক্তির এসব ডিভাইস নির্দিষ্ট সময়ের পর অকেজো হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রেও সেটি হচ্ছে। প্রশিক্ষণ না দিয়ে ডিভাইস দেয়া হয়েছে। এখন শিক্ষকরা ক্রমান্বয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। এদিকে ডিভাইসগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই আগেই প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম চালু করলে ভালো হতো।
পাঠদানে ডিজিটাল কন্টেন্টের অনিয়মিত ব্যবহারের বিষয়টি উঠে এসেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) পর্যবেক্ষণেও। এক্ষেত্রে বেশকিছু সমস্যার কথা বলা হয়েছে আইএমইডির মূল্যায়নেও। প্রকল্পের অধীন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন শেষে আইএমইডি জানিয়েছে, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন সম্ভব হয়নি। ডিজিটাল কন্টেন্টের মাধ্যমে পাঠদানের বিষয়টি কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনিয়মিত পরিলক্ষিত হয়েছে, যা কাম্য নয়। এছাড়া এক প্রতিষ্ঠানে একটি করে ল্যাপটপ বরাদ্দ সেখানকার শিক্ষার্থীর সংখ্যার অনুপাতে অপ্রতুল। ডিজিটাল কন্টেন্ট তৈরিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের সংখ্যাও পর্যাপ্ত নয় বলে আইএমইডি উল্লেখ করেছে।
ডিজিটাল কন্টেন্টের মাধ্যমে শিক্ষাদানের উদ্যোগ যাতে সফলভাবে পরিচালিত হয়, সেজন্য একাধিক সুপারিশ করেছে আইএমইডি। এর মধ্যে রয়েছে সরবরাহ করা ল্যাপটপ, প্রজেক্টর ও মডেম যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুকূলে রাজস্ব বাজেটের আওতায় পর্যাপ্ত তহবিল প্রদান। পরবর্তী সময়ে এ ধরনের প্রকল্পের ক্ষেত্রে মানসম্মত কম্পিউটার সরবরাহের ওপরও জোর দিয়েছে আইএমইডি।
এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষার প্রসারে সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। যুগোপযোগী শিক্ষা নিশ্চিত করতে মাল্টিমিডিয়া পদ্ধতিতে ক্লাস নেয়ার প্রকল্প নেয় সরকার। এর আওতায় সারা দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছে দেয়া হয় ল্যাপটপ, প্রজেক্টর ও ইন্টারনেট মডেম। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে এমএমসি নিশ্চিত করা হয়েছে। এখন শিক্ষকদেরও প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হচ্ছে। প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের কারণেই ডিজিটাল কন্টেন্টে ক্লাস বাস্তবায়নের হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।