বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন বলিষ্ঠ কণ্ঠে স্বাধীনতার ডাক দিলেন, উপেক্ষা করতে পারেনি পরাধীন দেশের অন্যতম প্রাচীন বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় (রাবি)। যেই বিশ^বিদ্যালয়ের মাটি রঞ্জিত হয়েছে শামসুজ্জোহার রক্তে, যেই বিদ্যাপীঠের মজ্জায় শিক্ষকের মহান আত্মত্যাগের চেতনা, সেই বিশ^বিদ্যালয় কি শোষণের শৃঙ্খল ভাঙতে পিছপা হয়? বঙ্গবন্ধুর ডাকে সংগ্রামী ঐতিহ্যের ধারায় বুকে অসীম সাহস নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এই বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। রোববার (১৫ ডিসেম্বর) জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন খুর্শিদ রাজীব।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদ নিশ্চিহ্ন করার যে ব্যর্থ প্রয়াসের সূচনা করে, তাতে আক্রান্ত হয় এই বিশ^বিদ্যালয়টিও। এর ধারাবাহিকতায় মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশ^বিদ্যালয়টি তার ৩ শিক্ষক এবং অন্তত ৩০ জন ছাত্র, কর্মকর্তা-কর্মচারীকে হারায়।
মনসুর রহমান খান সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর জনসাধারণের প্রবল প্রতিরোধে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে রাজশাহীতে সক্রিয় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য হয়। ১০ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি বিপুল অংশ শহরে প্রবেশ করে। ১৩ এপ্রিল ভোরে পাক সেনারা বিশ^বিদ্যালয়ে পৌঁছে আর্টিলারি ফায়ার ও জঙ্গী বিমানের গোলাবষর্ণ অব্যাহত রাখে। তারা জোহা, জিন্নাহ (বর্তমান শেরে বাংলা) হলসহ অন্যান্য আবাসিক হল, বিশ^বিদ্যালয় ক্লাব ও অতিথি ভবন দখল করে নেয়। ধ্বংস করে দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার। হাবিব ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার, ল্যাবরেটরিতে লুটতরাজ চালায়।
রাবির শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা থেকে জানা যায়, এই সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নির্যাতনে শাহাদতবরণ করেন ৪ শিক্ষক। বিশ^বিদ্যালয় দখলের পরদিন ১৪ এপ্রিল সংস্কৃত বিভাগের শহীদ অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দারকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর দিন ১৫ এপ্রিল গণিত বিভাগের রিডার শহীদ অধ্যাপক হবিবুর রহমানকে সেনাবাহিনী তুলে নেয়। তাঁর হদিস এখনও পাওয়া যায়নি। মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মীর আবদুল কাইউমকে ২৫ নবেম্বর জীবন্ত কবর দেয়া হয়। পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীর অকথ্য নির্যাতন ভোগ করেছিলেন গণিত বিভাগের শিক্ষক মজিবর রহমান।
এছাড়াও শহীদ হয়েছেন বিশ^বিদ্যালয়ের কর্মচারী প্রশাসনিক ভবনের নৈশপ্রহরী আবদুর রাজ্জাক, স্টেনো টাইপিস্ট শেখ এমাজউদ্দিন, উচ্চমান সহকারী এসএম সাইফুল ইসলাম, প্রকৌশল দফতরের কর্ম সহযোগী মো. কলিম উদ্দিন, সুইপার মোহনলাল, পরিবহন শাখার ড্রাইভার আবুল আলী, কাঠমিস্ত্রি শফিকুর রহমান, প্রহরী নূরু মিঞা, উপাচার্য অফিসের জরুরী পিয়ন মোহাম্মদ ইউসুফ, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ দফতরের পিয়ন মো. ওয়াজেদ আলী, প্রহরী মো. আফজল মৃধা, অর্ডালি পিয়ন ওয়াহাব আলী, বেয়ারা আবদুল মালেক, কিউরেটর মনছুর আহমদ খান, প্রহরী হোসেন আলী।
মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ভূমিকাও ছিল অসামান্য। স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ হয়েছেন বাণিজ্য বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবদুল মান্নান আখন্দ, শাহজাহান আলী, বাংলা বিভাগের আমীরুল হুদা জিন্নাহ, এমএসসি ছাত্র গোলাম সারওয়ার খান সাধন, রসায়ন বিভাগের প্রদীপ কুমার রাহা, অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র মোহাম্মদ আলী খান, পদার্থবিদ্যা বিভাগের ছাত্র মিজানুল হক।
স্থানীয়রা বলছেন, বিশ^বিদ্যালয়টি দখলে নিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর নির্মম নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালায় পাক বাহিনী। ৯ মাসে অন্তত ৪ হাজার বাঙালীকে হত্যা করা হয় এখানে। নির্যাতনের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হত শহীদ শামসুজ্জোহা হল। যার প্রমাণ এর আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য গণকবর। গবেষকদের ধারণা, পদ্মা নদীর তীর জুড়ে রয়েছে আরও গণকবর যা এখনও চিহ্নিত করা হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে এই বিশ^বিদ্যালয়টিতে রয়েছে অনেক স্মৃতি-স্মারক, ভাস্কর্য, ম্যূরাল প্রভৃতি। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ৩ শিক্ষকের নামে রয়েছে বিশ^বিদ্যালয়ে ৩টি হল ও আন্তর্জাতিক ডরমেটরি। ১৯৯৮ সালে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল খালেকের উদ্যোগে বিশ^বিদ্যালয়ের গণকবরে একটি ‘বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মাণ করা হয়। রাকসু নেতারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভিত্তি করে গড়েছেন ‘সাবাস বাংলা’ ভাস্কর্য। ভাষা শহীদদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে বর্তমান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটি গড়া হয়েছে। এই শহীদ মিনার প্রাঙ্গণেই রয়েছে দেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর- শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা। ১৯৭৬ সালে তৎকালীন ভিসি প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসানের উদ্যোগে এই সংগ্রহশালাটি নির্মাণ করা হয়। এছাড়া বিশ^বিদ্যালয়টির ৪ শহীদ শিক্ষকের আত্মত্যাগ ধারণ করতে সম্প্রতি গড়ে তোলা হয়েছে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভ’।