‘একাত্তরের জননী’সহ ১৮টি গ্রন্থের লেখক, মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতনের শিকার নারী রমা চৌধুরী আর নেই। আজ সোমবার ভোররাত ৪টা ৪০ মিনিটে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।
রমা চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হাড়ের ব্যথাসহ নানা রোগে ভুগছিলেন। গত বছরের ডিসেম্বরে বাসায় পড়ে গিয়ে কোমর ভেঙে গিয়েছিল তাঁর। সেই থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। কয়েক দিন আগে অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয়। গতকাল রাত ১০টায় তাঁকে সেখানে লাইফ সাপোর্টে দেওয়া হয়।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন আজিজুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, ভোররাত ৪টা ৪০ মিনিটে রমা চৌধুরীর লাইফ সাপোর্ট খুলে দেওয়া হয়। আজ চট্টগ্রাম শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বোয়ালখালীর গ্রামের বাড়িতে রমা চৌধুরীকে সমাহিত করা হবে।
রমা চৌধুরী ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন রমা চৌধুরী। তিনিই ছিলেন দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম নারী স্নাতকোত্তর (এমএ)। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে কক্সবাজার বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। দীর্ঘ ১৬ বছর তিনি বিভিন্ন উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসব অগণতি মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন তাদের একজন চট্টগ্রামের এ রমা চৌধুরী। ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স করে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ তার জীবনটাকে ওলটপালট করে দেয়। মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তীতে নিজের জীবনযুদ্ধের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সেই সময়ের বলি হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে তার তিন ছেলেকেও।
নিজের এবং জীবিত এক ছেলের মুখের ভাত জোটাতে প্রায় ৩০ বছর ধরে খালি পায়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে নিজের লেখা বই বিক্রি করেছেন তিনি। কখনও কারও কাছে সাহায্যের জন্য হাত পাতেননি। প্রচণ্ড আত্মমর্যাদাশীল এ সংগ্রামী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহায্যের প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
জীবনের শেষবেলায় এসে রমা চৌধুরীর শরীরে বাঁধে নানা অসুখ। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ২৪ ডিসেম্বর বাসায় পড়ে গিয়ে কোমরে গুরুতর আঘাত পান রমা চৌধুরী। ওই দিনই তাকে বেসরকারি ক্লিনিক মেডিকেল সেন্টারে ভর্তি করা হয়। সেই যে বিছানায় শয্যাশায়ী হয়েছেন আর দাঁড়াতে পারেননি।
আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে নিজের লেখা বই ফেরি করে বিক্রি শুরু করেন রমা চৌধুরী। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের জুন মাস পর্যন্ত নিজের নিয়মে বই বিক্রি করে গেছেন তিনি।
তার উল্লেখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘একাত্তরের জননী’, ‘এক হাজার এক দিন যাপনের পদ্য’ এবং ‘ভাব বৈচিত্র্যে রবীন্দ্রনাথ’-সহ ১৮টি বই। এসব বই বিক্রি করেই চলতো তার সংসার।