মুখ ও মুখোশে বাংলা ভাষা - দৈনিকশিক্ষা

মুখ ও মুখোশে বাংলা ভাষা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের জীবনাচরণের একটা বিশেষ পার্থক্যগত দিক হলো, প্রাচ্যের মানুষ ভবিষ্যতের ভাবনায় সঞ্চয়ের চেষ্টা করেন। আর পাশ্চাত্যের মানুষ প্রতিনিয়ত জীবনটাকে পরখ করে দেখেন। আর এক্ষেত্রে তাদের এগিয়ে রাখেন তাদের রাষ্ট্র এবং সমাজ ব্যবস্থায় প্রবীণ কিংবা কর্মক্ষমতা হারানো মানুষগুলোর দায়িত্ব নেয়ার সুব্যবস্থা রয়েছে। আর এর কারণ সেই অঞ্চলগুলোর সম্পদের প্রাচুর্য এবং সুষ্ঠু বণ্টন। তবে এই প্রাচ্যও একসময় সম্পদের প্রাচুর্যে দিন কাটিয়েছে। রোববার (১৯ জানুয়ারি) জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, যদিও এখন সেটা শুধুই অতীত। কারণ মুহুর্মুহু ভিনদেশী আক্রমণ, ধূর্ত বেনিয়াবৃত্তি, নিজেদের ধর্মীয় অন্ধত্ব, জাতিগত বিদ্বেষ সব কিছুর ফলাফলে প্রাচ্য এখন তার ‘স্বাতন্ত্র্যবোধ’ হারিয়েছে। এজন্য খুব দূরবর্তী ইতিহাস নয়, কিছুদিন পূর্বে তাড়ানো ব্রিটিশ শাসন পর্যালোচনাই যথেষ্ট। ঐ সময়টায় ঔপনিবেশিক শৃঙ্খলে এখানকার ‘মাটি এবং সংস্কৃতি’ ছিল পুরদস্তুর বঞ্চনাগ্রস্ত। ক্ষমতা কাঠামোর নিম্ন বিন্দুতে ছিল এই অঞ্চলের মানুষের অবস্থান।

তবে সৃষ্টি এবং সময়ের দাবিতে সেই ক্ষমতাধরদের পালাবদল ঘটেছে। ব্রিটিশদের ভাগানো হয়েছে, পাকিস্তানীদের তাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বাংলার সেই সহজিয়া ‘স্বাতন্ত্র্যবোধ এবং সংস্কৃতি’কে আজও পুরো উদ্যমে বুকে আগলানো সম্ভব হয়নি। বরং একে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে নিত্যনতুন পাঁয়তারা চলছে ’৭১-এর পূর্ব সময়টায় যে অপচর্চা ছিল খোলামেলা, আজ তা হচ্ছে ভদ্রতার মুখোশে।

একেবারে শুরুর লুটতরাজের ইতিহাস পেছনে ফেললেও, ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শোষণ এবং ২৩ বছরের পাকিস্তানী শোষণ, সব মিলিয়ে শোষণের প্রায় ২১৩ বছরের গল্পটা থেকে যায়। এই দীর্ঘ শোষণের ‘অভ্যস্ত’ হাতুড়ির তলে যে কেউ তার স্বকীয়তা এবং স্বাতন্ত্র্যবোধ হারাবেন এটাই বাস্তবতা।

ইতিহাস মতে, তৎকালীন পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক প্রায় সব ক্ষেত্রেই বৈষম্য প্রকট ছিল। তবে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি মারাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছিল তা হলো সাংস্কৃতিক বৈষম্য। নৃতত্ত্ব মতে সংস্কৃতি হলো, ‘ঞড়ঃধষ ধিু ড়ভ ষরভব’। অর্থাৎ, ‘জীবনের দৈনন্দিন যাপন বা অতিবাহনই হলো সংস্কৃতি’। ভিন্নভাবে বললে, একটা মানব শিশুর জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যুর শেষকৃত্য পর্যন্ত সংস্কৃতির অংশ।

আর এই সংস্কৃতির একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ভাষা। যেখানে প্রথম আঘাত করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তা। ফলাফল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ’৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানী সামরিক শক্তির ‘কারফিউ-ব্যারিকেড’ উপেক্ষা। শহীদ হলেন সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, সফিউরের মতো অকুতোভয় ছাত্র-জনতা।
 
অথচ এই শতকে এসে এই বাঙালীরাই সেই ‘ভাষা’কে আবেগহীনভাবে ব্যবহার করছেন। প্রাসঙ্গিক উদাহরণ দেশের পর্যটন শিল্পের দুই মানিকজোড় ‘কক্সবাজার এবং সেন্টমার্টিন’।

বিশ্বের দীর্ঘতম এই সমুদ্র সৈকতের ‘নামকরণ’ স্মরণ করিয়ে দেয় এই অঞ্চলের মানুষের ঔপনিবেশিক দাসত্বের কথা। নামকরণের গল্পটা বলি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তৎকালীন গবর্নর জেনারেল ‘ওয়ারেন হেস্টিং’ আরাকান উদ্বাস্তু এবং আঞ্চলিক রাখাইনদের মাঝে সংঘর্ষ দমনে দায়িত্ব অর্পণ করেন ক্যাপ্টেন ‘হিরাম কক্সকে’। উপকূলীয় বিদ্রোহ দমনের দায়িত্ব যথার্থই পালন করেন ‘হিরাম কক্স’। কিন্তু চাকরির মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই কর্মস্থলে মারা যান তিনি।

আর এ কারণে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সেখানকার একটি মার্কেটের নামকরণ করা হয় ‘কক্স মার্কেট’। কিন্তু অত্যধিক তাবেদারি করা একটা অংশ শেষমেশ পুরো সৈকতেরই নামকরণ করে ফেলে ‘কক্সবাজার’! আর হারিয়ে যায় এর অমৃত সুন্দর নাম ‘পালঙ্কি’।

প্রবালদ্বীপ ‘সেন্টমার্টিনের’ ক্ষেত্রেও তাই। সেন্ট জোসেপ নামক একজন পাদ্রীর নামানুসারে ব্রিটিশরা এই দ্বীপের নামকরণ করে গিয়েছিলেন। যা এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশ। অথচ বাংলায় এর শ্রুতিমধুর নাম-ডাক ছিল ‘নারিকেল জিঞ্জিরা’।

তবে তামাশার বিষয় হলো, এই সুরেলা-সুমিষ্ট ‘বাংলা’ দৈন্যতার কারণ বাঙালীর শখের আধুনিকতা। আর এ কারণেই বাঙালী তার ‘স্বাতন্ত্র্যবোধ এবং জাত্যাভিমান’ ভুলতে বসেছে। যার এক টুকরো দলিল বিশ্ব সৌন্দর্যের ভাণ্ডার ‘কক্সবাজার এবং সেন্টমার্টিনের’ প্রচলিত ঔপনিবেশিক নামকরণ বয়ে চলা। যদিও এই দুই পর্যটন স্থানের নামকরণ বাংলায় প্রচলিত থাকার একটা বিশেষ দিকও ছিল।

সৌন্দর্য এবং পর্যটন শিল্পের জন্য এই দুইয়ের নাম পৃথিবী অনেক দেশের মানুষ জানে। কাজেই এই দুই পর্যটন স্থানের নামকরণ বাংলায় প্রতিষ্ঠিত থাকলে বিশ্ব অন্তত দুটি বাংলা শব্দ জানতে পারত। যা একই সঙ্গে হতো আমাদের বাঙালিত্ব এবং জাত্যাভিমানের প্রতিষ্ঠা। যদিও এই বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার পথ বেশ কণ্টকাকীর্ণ। কারণ দেশের আইন আদালত, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজের নামকরণের ক্ষেত্রেও দেখা যায় বৈদেশিক নামকরণের যথেচ্ছ ব্যবহার।

তাছাড়া পাড়ার নামকরণ এবং বাসাবাড়ির নামকরণেও চোখ কপালে ওঠার অপক্রম। যেমন- রাজধানী ঢাকার ‘ধানমণ্ডি’ এলাকায় প্রবেশ করলে হঠাৎ মনে হতে পারে আপনি হয়ত পাশ্চাত্যের কোন শহর- লস এঞ্জেলেস, প্যারিস কিংবা অন্য কোথাও আছেন। কেননা এখানকার ‘স্কুল, কলেজ থেকে শুরু করে ঘর-বাড়ির নাম, খাবার দোকানগুলোর’ নাম, খাবারের তালিকা প্রায় সর্বত্রই ভিনদেশী ভাষার ব্যবহার।
 
তাছাড়া যে ভাষার জন্য বাঙালী প্রাণ দিয়েছেন সেই ভাষা যখন শুধু একটি মাস কেন্দ্রিক উদযাপন কিংবা অবলম্বনে ধ্বনিত হয় সেটাও কষ্টদায়ক। কারণ মগজে বাংলা এবং বাঙালিত্বের প্রোথিত শিখা আজও সেখানে অনুপস্থিত। যেমন স্বনামধন্য এক মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক তার মেয়েকে বাংলা মিডিয়াম স্কুল থেকে সরিয়ে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন। কারণ ওই বাংলা মিডিয়াম স্কুলটিতে তার কম্পাউন্ডারের মেয়ে ভর্তি যুদ্ধের মাধ্যমে সুযোগ পেয়েছেন। অর্থাৎ, তার এই শ্রেণীদ্বন্দ্বের আচরণে জাতির শিকড়-সংস্কৃতি থেকে বঞ্চিত হবে ‘ভবিষ্যত বাংলাদেশ’।

বৈশ্বিক সংস্কৃতিতে টিকে থাকতে ভিনদেশী ‘ভাষা এবং সংস্কৃতি’ জ্ঞান আবশ্যক। এই মতবাদ বা চিন্তায় কোন দ্বিমত নেই। তবে সেটা অবশ্যই আগে ঘরের ‘ভাষা এবং সংস্কৃতি’কে বুঝে। আর এই সফল পরিক্রমণেই হবে সকল শহীদদের প্রতি জানানো যথার্থ সম্মান।

লেখক : হায়দার মোহাম্মদ জিতু, ছাত্রনেতা।

দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0043821334838867