নৈতিকতা হলো নীতির অনুশীলন। কথা ও কাজে উত্তম রীতি-নীতির অনুশীলন করা, মার্জিত ও বিনয়ী হওয়া, উত্তম চরিত্রবান হওয়া ইত্যাদি। অন্যায়, অশ্লীল ও অশালীন বিষয়সমূহ পরিত্যাগ করাও নৈতিকতার অন্তর্ভুক্ত।
নৈতিকতা ও নীতির অনুশীলন মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। নীতিহীন মানুষ পশুর সমান। কেননা পশুর কোনোরূপ নীতিবোধ নেই। সে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। ভালো-খারাপ, কল্যাণ-অকল্যাণ কোনো কিছুই সে পরোয়া কওে না। সে শুধু নিজের লাভ ও কল্যাণই বুঝে। নীতিহীন মানুষও ঠিক তেমনি। সে কোনোরূপ আইন-কানুন, বিধি-বিধান মানে না, সে নৈতিক আচরণ পালন করেন বরং নিজের লাভের জন্য সে অপরের ক্ষতি সাধন করে। মিথ্যা, প্রতারণা, ধোকা দেয়া, পরচর্চা ইত্যাদি তার চরিত্রে ফুটে উঠে। সমাজে সে নানারূপ অশান্তি সৃষ্টি করে। কোনো মানুষই তাকে ভালোবাসে না।
অন্যদিকে, নৈতিকতা মানুষকে প্রকৃত মানুষে পরিণত করে। নীতিবোধ সম্পন্নমানুষ সমাজে সকল মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা লাভ করে। সকলে তাকে সম্মান করে। সে সব সময়নীতি ও উত্তম আদর্শ লালন করে এবং নৈতিকতার বিশ্বাসসমূহ নিজের জীবনে ফুটিয়ে তুলে। অন্যায়, অত্যাচার অশ্লীলতা থেকে সর্বদা দূরে থাকে। সমাজে উত্তম ব্যক্তি ও আলোকিত ব্যক্তি হিসাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়। নিজে মার্জিত অমায়িক, স্নেহভাজন ও জবাবদিহি নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে পরিবার ও সামাজিক দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকে।
নৈতিকবোধ সম্পন্ন মানুষ নিজের পারিবারিক জীবন ও সামাজিক জীবনে সৃষ্টিকর্তার আদেশ, রাষ্ট্রেরবিধি-বিধান মেনে চলে। মানুষের সঙ্গে উত্তম আচরণ, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সময়ানুবর্তিতা, নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলাবোধ ও সাম্যের শিক্ষা গ্রহণ করে সমাজের জন্য, পরিবারের জন্য ভালো কাজ করে। অন্যকে ভালো কাজের পরামর্শ দেয়। পরিবারের প্রধান ব্যক্তি সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করার মাধ্যমে সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা, আনুগত্য প্রতিষ্ঠা করে। এতে সমাজজীবন সুখ ও শান্তিময় হয়ে উঠে। ঔদ্ধত্য, অশালীন চলাফেরা ও কথাবার্তা, সমাজের মধ্যে দলাদলীতে অংশগ্রহণ করা, কারো সম্পদ, অর্থ, সম্মান, অন্যের জীবনে কোনো প্রকার ক্ষতি সাধন করা, ফাঁকি দেয়া, ধোকা দেয়া, সুদ, ঘুষ, জুলুম, খুন ধর্ষণ অমানবিক ও পাপের কাজ। এছাড়া ভেজাল দাতা, যৌতুক গ্রহণ, এতিম, দুর্বল ও বিধবাদের সম্পদ দখলকারী, দুর্নীতির মাধ্যমে কারো সম্পদ গ্রহণ, মানুষের অধিকার হরণ করা অনৈতিক কাজ। যা সমাজের মানুষকে কষ্ট দেয় এবং সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করে।
জীবনের সকল ক্ষেত্রে মনুষ্যত্ব ও নীতি আদর্শের শিক্ষাকে ধরে রাখার চেষ্টা ও চেতনাই নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ। আদর্শ সমাজ গঠনের জন্য মূল্যবোধের প্রয়োজন অত্যন্ত বেশি। নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ মানুষকে উত্তম চরিত্রবান করে গড়ে তুলে। সততা, নৈতিক ও মানবিক আচরণের অনুশীলন করলে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
অন্যদিকে, সমাজে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ না থাকলে সমাজে শান্তি থাকে না। দুর্নীতি, সন্ত্রাস ,চুরি, ছিনতাই প্রতারনা ছড়িয়ে পড়ে। মানুষের মধ্যে দয়া-মায়া, ঐক্য, ভালোবাসা ইত্যাদি সদগুণাবলীর চর্চা থাকে না। মানুষ পরষ্পরকে অবিশ্বাস ও সন্দেহ করে। ফলে সমাজে নানা অরাজকতা ও অশান্তি সৃষ্টি হয়। সমাজে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্য দয়া, ক্ষমা, সাম্য, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ব, ভালোবাসা, পরষ্পরের সহযোগিতা, বিশ্বাস যোগ্যতা ইত্যাদি গুণাবলীর অনুশীলন অত্যন্ত জরুরি। আবার মিথ্যা বলা, প্রতারণা করা, চুরি, দুর্নীতি, গালাগালি, হিংসা-বিদ্বেষ, গর্ব, অহংকার, খোশামোদ, তোষামোদ ইত্যাদি খারাপ কাজ। এগুলো মানবিক আদর্শের বিপরীত। এগুলো নৈতিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করে।
সৎ গুণাবলীর অনুশীলন ও অসৎ কর্মকাণ্ড থেকে বেঁচে থাকার মাধ্যমে আমরা উত্তম চরিত্রবান হতে পারি। পিতা-মাতার খেদমত, আত্মীয় স্বজনপাড়া-প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্বপালন, সৎ জীবনযাপনের মাধ্যমে আদর্শ পরিবার গঠন, সৃষ্টির সেবা ও সহযোগিতা, যে কোনোভাবে মানুষের উপকার করা, অসহায়কে সাহায্য করা, বিপদে মানুষের পাশে দাড়াঁনো, অর্থ ও মুখের কথায় মানুষকে সাহায্য করা, মানুষের অধিকার আদায়ে সহযোগিতা করা ইত্যাদি ভালো কাজ আমাদের নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসাবে গড়ে তোলে। কেননা নৈতিকতা ও মূল্যবোধ মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় গুণ আর মনুষ্যত্ব অর্জনের সাধনায় মানুষ শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে।
আমাদের প্রিয় মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘সেই ব্যক্তিই সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, যার কাছ থেকে মানবতা নানাবিধ কল্যাণ লাভ করে।’ এভাবে সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন, ‘কোন কাজগুলি সর্বোৎকৃষ্ট? কোনো মানুষের হৃদয়কে সন্তুষ্ট করা, কোনো ক্ষুধার্তকে আহার দান করা, কোনো বিপদগ্রস্থ লোককে সাহায্য করা, কোনো ব্যথিত লোকের ব্যথার উপশম করা, কোনো অন্যায়ভাবে কষ্টপ্রাপ্ত লোকের কষ্টের প্রতিকার করা।’
সকল মানুষই সমান এবং সম-মর্যাদার অধিকারী ও একই পরিবারভুক্ত লোকের মতো। কাজেই মানুষের কল্যাণ সাধনই মানবজীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কর্তব্য। মানব সেবা নিজ মনন ও চেতনায় ধারণ করে মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি সমাজজীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে। হিংসা, অহংকার, আত্মমুখিতা, কৃপনতা, নিষ্ঠুরতা লোভ, ক্রোধ অনৈতিকতায় পথ দেখায়। অপরদিকে বিনয়, উদারতা, দানশীলতা, দয়াদ্রতা সদাচরণ ইত্যাদি গুণাবলী মানুষের নৈতিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত কওে এবং সমাজ সচেতন উন্নত সমাজ গঠনের রূপকার হিসাবে সমাজে সমাদৃত হয়।
উন্নত নৈতিক চরিত্রের মানুষই হচ্ছে গুণী মানুষ, যিনি উত্তম আদর্শ লালন করে আমাদের উন্নত পারিবারিক জীবন গঠন ও সমাজকে আলোর পথ দেখান। গুণী মানুষের মহৎ কর্ম ও চারিত্রিক আদর্শ সমাজের মধ্যে অনন্য, উজ্জ্বল, দীপ্তমান হয়ে উঠে। তিনি সততাই সর্বোৎকৃষ্ট নীতি- এই আদর্শ ধারণ করে সত্যপরায়ণতা ও নৈতিক আদর্শ লালন করে সুস্থ সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলেন। তিনি মিথ্যা বলেন না, ওয়াদা ভঙ্গ করেন না, কারো ক্ষতি সাধন করেন না, কারো সঙ্গে প্রতারণা করেন না, অন্য কে গাল মন্দ করেন না। মিথ্যাচার, পরনিন্দা, গাল-মন্দ করা ইত্যাদি নৈতিক অবক্ষয়মূলক আচরণ।
সত্যকে ধারণ করতে হবে মিথ্যাকে পরিত্যাগ করতে হবে। কেননা মিথ্যা একটি জঘন্যতম অপরাধ। এটি সকল পাপ কাজের মূল। প্রতারণা, প্রবঞ্চনা, অন্যের মাল গ্রহণ এসব অনৈতিক ও সমাজ বিরোধী কর্মের মূলে রয়েছে মিথ্যাচার। যে সমাজে মিথ্যা বৃদ্ধি পায়, সে সমাজ ক্রমে ক্রমে ধ্বংসের দিকে অগ্রসর হয়। কোনো জাতীর সামগ্রিক জীবনাচরণে সততা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটলে জাতীয় জীবনে নেমে আসে বিপর্যয়ের অশনিসংকেত। শিক্ষা ও মূল্যবোধের যথাযথ সমন্বয়ের মাধ্যমে আমরা জাতিকে উন্নত ও মর্যাদাবান করে গড়ে তুলতে পারি। মনুষ্যত্ব ও মানবিকতা আদর্শ লালন করে মানবিক কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখি। আসুন আমরা সবাই অঙ্গীকার করি সুন্দর সমাজ গঠনে চিন্তা ও কর্মে সৎ থেকে আদর্শ নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করি। সততা ও দেশ প্রেম লালন করে উন্নত মূল্যবোধ সম্পন্ন জাতি গঠনে ভূমিকা রাখি।
লেখক : মো. আবু সামা মিঞা (ঠান্ডু), সহকারী অধ্যাপক (অব.), বীরগঞ্জ, দিনাজপুর।
[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন।]