মেধা বিকাশে কতটা সহায়ক পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষায় গড়ে ৮০ নম্বরে জিপিএ-৫ পাওয়া - দৈনিকশিক্ষা

মেধা বিকাশে কতটা সহায়ক পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষায় গড়ে ৮০ নম্বরে জিপিএ-৫ পাওয়া

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করেছিলেন দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই। তখন দেশের অর্থনৈতিকসহ সার্বিক যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থার মধ্যে এমন যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করা শুধু তার পক্ষেই সম্ভব ছিল। দেশ গড়তে প্রথম প্রয়োজন শিক্ষা; তাই প্রাথমিক শিক্ষাকে শুরুতেই গুরুত্বসহকারে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন তিনি। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেটের আঘাতে সবকিছু ওলটপালট না হয়ে গেলে আমরা হয়তো এতদিনে দেখতে পেতাম দেশের প্রাথমিক শিক্ষা একটা অভিন্ন কারিকুলামের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। একই ধারায় চলছে দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা। একই ধারার মনমানসিকতা নিয়ে গড়ে উঠছে দেশের সব শিশু-কিশোর যেটা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে নিতান্তই প্রয়োজন। মঙ্গলবার (২৪ মার্চ) সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, প্রবাদ আছে ‘জ্যাক অব অল ট্রেডস, মাস্টার অব নান’। ছোটদের বেলায় কথাটা প্রযোজ্য হবে না এটা বলা যাবে না। ছোট হোক বড় হোক সব বিষয়ে কেউ সমান পারদর্শী হতে পারে না। একজন খেলাধুলায় পারদর্শী হলেও সব খেলায় সে পারদর্শী হতে পারে না। খ্যাতিমান খেলোয়াড় একটা খেলাতেই হতে পারে। যার সাহিত্যে অনুরাগ রয়েছে সে শিল্প-সাহিত্যের সব দিকে রবীন্দ্রনাথের মতো ক্ষণজন্মা না হলে বিচরণ করতে পারে না। যার বিজ্ঞানের প্রতি ঝোঁক রয়েছে পদার্থ-রসায়ন-জীববিজ্ঞান বা বিজ্ঞানের কোন একটা দিকে সে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পারে- সবটাতে নয়।

কথা এখানে মেধা বিকাশের পথটা খোলা রাখা নিয়ে। একজন স্কুল শিক্ষার্থী পারছে, পারবে না কেন- সব বিষয়েই ৮০ নম্বরের ওপরে তুলছে, জিপিএ-৫ পাচ্ছে। তাদের সংখ্যাও কম না। কিন্তু কেউ তার আগ্রহের বিষয়টাতে সময় একটু বেশি দিতে পারছে কি। পারছে না। বরং একটা ভয় সবসময় তার ভেতর, তার অভিভাবকের ভেতর কাজ করছে যে, কোন একটাতে যদি ৮০ নম্বরের নিচে হয়ে যায় তাহলে আর জিপিএ-৫ পাওয়া হবে না। আর জিপিএ-৫ না পেলে শুরুতেই পেছনে পড়ে গেল। এ ভয়টা দূর করা দরকার। দূর করতে না পারলে কোন শিক্ষার্থী তার নিজের আগ্রহের কোন বিষয়টিতে সময় দিতে পারবে না। নিজের মতো করে কিছু ভাবতে পারবে না। আমরা সবাই জানি এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের কিছু করার নেই। যা করার করছেন শিক্ষক সাহেবরা, করছেন অভিভাবকরা। আর করছেন কর্তৃপক্ষ সঙ্গে সরকার। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ে টানছেন। দিনরাত প্রস্তুতিমূলক পরীক্ষা নিচ্ছেন। একটা শক্তিশালী গোষ্ঠী নোট-গাইড জোগান দিয়ে রমরমা বাণিজ্য ফেঁদে বসেছেন। অভিভাবকরা টাকার জোগান দিচ্ছেন। যে যত বেশি জোগান দিতে পারছেন তিনি তার সন্তানের জন্য তত বেশি দামি সনদ কিনতে পারছেন। সরকার বিনামূল্যে সবাইকেই বই দিচ্ছেন। দরিদ্র-অসচ্ছল অভিভাবকদের সন্তানদের উপবৃত্তি দিচ্ছেন। অনেক স্কুলে বিস্কুট জাতীয় কিছু খাবারও দিচ্ছেন। সব মিলে এনরোলমেন্ট সন্তোষজনক শুধু না বিস্ময়কর সন্তোষজনক। কিন্তু শিক্ষার মান নিয়ে বড় বিব্রত অবস্থা যাচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থীর অক্ষরগুলো চিনতেই লেগে যাচ্ছে প্রাইমারির প্রায় সবটা সময়। বিশ্বব্যাংক বলেছে আমাদের শিশুরা প্রথম শ্রেণীতে যা শেখার কথা তা শিখছে পঞ্চম শ্রেণীতে গিয়ে। এ অবস্থায় এনরোলমেন্ট নিয়ে কেউ কেউ বলছেন, যে জিনিসের মান নেই সে জিনিস বেশি তৈরি হলেই বা কী, না হলেই বা কী। অবস্থাদৃষ্টে এমন কথা আসতেই পারে। আবার অনেকে বলছেন বিষয়টা এভাবে নিলে হবে না। একটা দিক যেমন হয়েছে আরেকটাও হবে। প্রায় সকল শিশুকে স্কুলমুখী করা গেছে এ এক বিস্ময়কর সফলতা। মান বাড়াতে যথাযথ চেষ্টা চলছে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয় তা যে যেখানেই পড়ুক।

পিইসি ও জেএসসির কথা বলছি। এ দুটো পরীক্ষায় কোন একটা বিষয়ে কারো ৮০’র নিচে নম্বর হয়ে গেলে সে আর জিপিএ-৫ পাচ্ছে না। সব বিষয়েই ৮০ বা তার ঊর্ধ্বে নম্বর পেতে হবে। একটাতে কম পেলে আরেকটা দিয়ে তা পূরণ করার সুবিধা তারা পাচ্ছে না। যে শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পাচ্ছে বুঝতে হবে সব বিষয়েই তার সমান আগ্রহ রয়েছে সে সমান পারদর্শী সব বিষয়ে। এখানে খেলাধুলা গানবাজনা অর্থাৎ এক্সট্রাকারিকুলামের কথা বাদ রেখেই বলতে চাচ্ছি- বাস্তবে সেটা কতদূর সম্ভব।

এখন যে বিষয়ে কেউ ৮০ পাওয়ার মতো ভালো করতে পারছে না তাকে বেশি সময় ধরে আটকে রাখা হচ্ছে, বেশি চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে তার ওপর। অভিভাবকের বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। কারণ কোন একটাতে ৬০, ৭০ হলে হবে না। যে করেই হোক তাকে ৮০ নম্বর পেতেই হবে। বলতে চাচ্ছি, এখানেই লেখাপড়া হয়ে গেছে কোচিং আর নোট-গাইডনির্ভর। হয়ে গেছে প্রস্তুতিমূলক পরীক্ষানির্ভর। তৈরি হয়ে গেছে অনৈতিক কার্যকলাপের রাস্তা। কারণ প্রত্যেকটা বিষয়ে তাকে তুলতে হবে ৮০ বা তার ঊর্ধ্বে নম্বর জিপিএ-৫ পেতে হলে।

আগের মতো প্রাপ্ত মোট নম্বরের গড় ভিত্তিতে কেউ স্ট্যান্ড করুক কেউ স্টার পাক কেউ প্রথম বিভাগ-দ্বিতীয় বিভাগ পাক তা বলতে চাচ্ছি না। বলতে চাচ্ছি গ্রেড পদ্ধতি রেখে বা তুলে দিয়ে পিইসি ও জেএসসির একজন শিশুশিক্ষার্থী কোন এক-দুই বিষয়ে ৬০, ৭০ পেয়েও কীভাবে জিপিএ-৫ পেতে পারে তার উপায় খুঁজে বের করার কথা। বিষয়টা এমনকি হতে পারে না যে, পিইসি ও জেএসসিতে গড়ে ৮০ নম্বর হলেই সে জিপিএ-৫ পাবে।

আগের সবকিছু ধরে থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় নবম শ্রেণী থেকেই বিষয়ভিত্তিক বিভাজন (বিজ্ঞান-কলা-বাণিজ্য) তুলে দেয়ার পক্ষে মত ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, এটা না থাকাই ভালো। এসএসসির পরে যদি বিভক্ত হয়, সেটাই ভালো। তিনি বলেছেন, সবই পড়ুক, তারপর যেখানে সে মেধা বিকাশের সুযোগ পাবে সেটা করে নেবে। তাহলে অন্তত, তাদের (শিক্ষার্থীদের) মেধা বিকাশের একটা সুযোগ হয়। তিনি শিক্ষার্থীদের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করে আরও বলেছেন, এখন সব সাবজেক্টই বিজ্ঞানভিত্তিক। সেটা ধীরে ধীরে চলেই এসেছে। বিজ্ঞানের বাইরে কিছু নেই (দৈনিক সংবাদ, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০)। বিজ্ঞানের বাইরে কিছু নেই, বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গঠনে এ অমোঘ সত্যের উপলব্ধি প্রধানমন্ত্রীর কথার সঙ্গে সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়–ক আমরা গভীরভাবে তা আশা করি।

নবম শ্রেণী থেকে বিষয়ভিত্তিক এ বিভাজন চলে আসছে বহু বছর ধরে বলা যায় সেই আমাদের সময় থেকে যা প্রায় ষাট বছর হতে চললো। প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই এর জন্য। আমরা পরিবর্তন চাই আরও ভালো কিছু চাই। চাই স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার কারিকুলাম নিয়ে নিরন্তর গবেষণা হোক। বছর বছর ভালো ভালো আধুনিক নিয়ম-নীতি-পদ্ধতি শিশুদের লেখাপড়ার ক্ষেত্রে বেরিয়ে আসুক এবং তা বাস্তবায়ন হোক। তিনি এর আগে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ুয়া শিশুদের কোন পরীক্ষা না নেয়ার কথা বলেছেন। এর শতভাগ বাস্তবায়ন আমরা আশা করি। তিনি পঞ্চম শ্রেণী থেকে পাবলিক পরীক্ষা তুলে দেয়ার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ করতে বলেছেন- আমরা স্বাগত জানাই। এ পর্যন্ত আমি দেখিনি কোন বিশেষজ্ঞ কোন বরেণ্য শিক্ষাবিদ এ পরীক্ষাটা রাখার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছেন। বরং ১২ ক্লাস পর্যন্ত লেখাপড়া করতে আমাদের শিশুদের যে চারবার পাবলিক পরীক্ষায় বসতে হচ্ছে এটাকে ‘টু মাচ’ বলেছেন। অনেকে বলেছেন চারটার মধ্যে দুইটা পরীক্ষাই তুলে দেয়া যেতে পারে। তার মধ্যে পিইসি তো বটেই। অন্যটা হতে পারে এসএসসি। থাকতে পারে কেবল জেএসসি এবং তার চার বছর পর এইচএসসি। কিন্তু এখন শুনছি পিইসি তুলে দেয়া তো দূরের কথা পরীক্ষাটির স্থায়ী ব্যবস্থা হতে যাচ্ছে। প্রাইমারির জন্য শিক্ষা বোর্ড হতে যাচ্ছে।

এসব নিয়ে মাঝে-মধ্যে টিভির টকশোতে অনেক সাবেক আমলার মুখেই শোনা যায় শিশুদের এমন সব পরীক্ষা বহাল রাখার পক্ষে জোরাল যুক্তি দেখাতে। তাদের কথায় মনে হয় বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ এসবের আর দরকার নেই আমলারাই যথেষ্ট। অথচ বঙ্গবন্ধুর করা জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সুপারিশে প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত করার যে প্রস্তাব সেটা বাস্তবায়িত হয় না। প্রাথমিকে অভিন্ন পাঠ্যসূচি প্রণয়নের প্রয়োজন নিয়ে কাউকে কথা বলতেও শোনা যায় না। এদিকে পিইসির জন্য বোর্ড হতে যাচ্ছে। যাতে শিশুরা ছাড়া সুবিধা হবে সবার। অবশ্য এর পেছনে প্রাইমারিকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করার কোন বিষয় থাকলে আলাদা কথা।

খাদ্য শিক্ষা চিকিৎসা এমন সব কাজে ছোটদের অগ্রাধিকার থাকা সভ্য সমাজের লক্ষণ। ছোটদের চাহিদা আগে পূরণ করে বড়দের কথা ভাবতে হবে। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে ৪টা পাবলিক পরীক্ষার (পিইসি জেএসসি এসএসসি এইচএসসি) মধ্যে অপেক্ষাকৃত বড়দের দুইটা পরীক্ষায় অর্থাৎ এসএসসি ও এইচএসসিতে একজন শিক্ষার্থী কোন একটা বা দুইটা বিষয়ে ৮০’র নিচে নম্বর পেয়েও জিপিএ-৫ পাচ্ছে। পাচ্ছে কারণ সেখানে ইলেক্টিভ একটা বিষয় রয়েছে। এ বিষয়ে প্রাপ্ত নম্বর থেকে পাসের অংশ বাদ দিয়ে বাড়তি নম্বর বা পয়েন্ট গিয়ে যুক্ত হচ্ছে ওই ৮০’র নিচে নম্বর পাওয়া বিষয়ের সঙ্গে। তাই বলে বলছি না যে পিইসি ও জেএসসির বেলায়ও ইলেক্টিভ বিষয় চাপাতে হবে। বলছি প্রাইমারি স্কুল সার্টিফিকেট (পিইসি) ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষায় গড়ে ৮০ নম্বর হলেই একজন জিপিএ-৫ পাবে সে ব্যবস্থা করতে। এতে ওদের ওই ভয়টা দূর হবে। নিজে পড়ার আগ্রহ পাবে। নোট-গাইড আর কোচিংয়ের দৌরাত্ম্যও কমে আসবে।

লেখক : আবদুল মান্নান খান।

ফল জালিয়াতি: পদে রেখেই সচিবের বিরুদ্ধে তদন্ত - dainik shiksha ফল জালিয়াতি: পদে রেখেই সচিবের বিরুদ্ধে তদন্ত শিক্ষক-কর্মচারী বদলি নীতিমালার কর্মশালা কাল - dainik shiksha শিক্ষক-কর্মচারী বদলি নীতিমালার কর্মশালা কাল দুবাইয়ে বন্যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা - dainik shiksha দুবাইয়ে বন্যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি ৯৬ হাজার ৭৩৬ শিক্ষক নিয়োগ, আবেদন করবেন যেভাবে - dainik shiksha ৯৬ হাজার ৭৩৬ শিক্ষক নিয়োগ, আবেদন করবেন যেভাবে ফিলিস্তিনকে সমর্থনের ‘অভিযোগে’ সেরা ছাত্রীর বক্তৃতা বাতিল - dainik shiksha ফিলিস্তিনকে সমর্থনের ‘অভিযোগে’ সেরা ছাত্রীর বক্তৃতা বাতিল মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে - dainik shiksha মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.009152889251709