মেধাবিকাশের পথে বাধা কোথায়? - দৈনিকশিক্ষা

মেধাবিকাশের পথে বাধা কোথায়?

ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী |

মেধা একটি সম্পদ, আর সেই দৃষ্টিকোণ থেকে মেধাবী প্রজন্ম গড়ে তোলা সংস্কৃতির একটি অংশ হতে পারে। বিশেষ করে যখন কোনো সমাজে বা রাষ্ট্রে মেধাবী মানুষদের সংখ্যা বেশি থাকে, তখন তাদের মেধাশক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সেই সমাজ বা রাষ্ট্র উন্নয়নের পথে এগিয়ে যায়। এই মেধাশক্তির প্রয়োগ এককভাবে বা সমন্বিতভাবে হতে পারে। অনেকে ভৌগোলিক অবস্থানের ভিন্নতার কারণে মেধার ভিন্নতার বিষয়টি বলে থাকলেও সেটি যৌক্তিক নয়। বরং মেধা বিকাশের জন্য একটি পরিকল্পিত পরিবেশ ও ভাবনার প্রয়োজন হয়। মেধার প্রকাশ ঘটে বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে। আবার এই বুদ্ধিমত্তা কেবল জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতিকেই বোঝায় না, এর সঙ্গে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ সৃষ্টির লক্ষ্যে কৌশলগত পরিকল্পনাকেও বোঝায়।

জাতিগত ভাবে বাঙালিরা মেধাবী হলেও এখানে মেধাচর্চা ও বিকাশের বিষয়টিকে অনেক ক্ষেত্রে অবহেলা করা হয়। এর ফলে যে পরিমাণ মেধাশক্তি সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল তা বজায় থাকে না। আবার মেধাকে ধরে রাখার ও এর উত্কর্ষ সাধনের যে কৌশলগুলো রয়েছে, সেগুলোও মেনে চলা সম্ভব হয় না। অনেকেই একটি বিষয় বলে থাকেন, আমাদের দেশে মেধাবিকাশের সুযোগ নেই। কথাটি সত্য নয়। বরং একজন মানুষ ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই মেধাবিকাশের ক্ষেত্রগুলো তৈরি করা যায়। এছাড়া মেধাকে প্রয়োগ করার যে পরিবেশ, তা সৃষ্টি করার ইতিবাচক মনোভাবও মানুষের মধ্যে থাকতে হয়। কোনো একটি সৃষ্টির ক্ষেত্রে মেধা প্রয়োগ করে থেমে থাকলে এর বিকাশ ঘটে না। একটি সৃষ্টির ভাবনা থেকে বহুমাত্রিক সৃষ্টির ভাবনা মেধাশক্তির বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে। অনেক সময় আমরা ইহুদিদের জাতি হিসেবে অনেক মেধাসম্পন্ন ও বুদ্ধিমান বলে বিবেচনা করে থাকি। কিন্তু তারা কেন এত মেধাবী এ বিষয়টি কখনো আমরা বিশ্লেষণ করে দেখি না। বরং এটি মনে করা হয় জন্মগতভাবেই একজন ইহুদি অন্য জাতিগোষ্ঠীর তুলনায় বেশি বুদ্ধিমান ও মেধাসম্পন্ন হবে। বিষয়টি কোনোভাবেই বিজ্ঞান সম্মত ও যৌক্তিক নয়।

তাদের বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও পরিকল্পনা যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সেটি কখনো আমরা ভেবে দেখি না। ইহুদি জনগোষ্ঠীর বুদ্ধিমত্তার এই বিষয়টিকে গবেষণা করতে গিয়ে ড. স্টিফেন কার লিওন কতগুলো বিষয়কে চিহ্নিত করেন। তাঁর ৮ বছরের এই গবেষণায় যে বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণভাবে উঠে আসে সেগুলো হলো—তাদের খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি, ধর্ম, গর্ভাবস্থায় প্রস্তুতিসহ অন্যান্য বিষয়। এই প্রতিটি বিষয় কোনো না কোনো ভাবে বিজ্ঞান, মনস্তত্ত্ব ও দর্শনগত ধারণার সঙ্গে যুক্ত। একটি শিশু যখন গর্ভাবস্থায় থাকে তখন মায়েরা গান বাজনা, পিয়ানো বাজানো ও তাদের স্বামীদের সঙ্গে গণিতের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে থাকেন। গর্ভবতী মহিলাদের এই সময়ের সঙ্গী হয় বিভিন্ন ধরনের গণিতের বই। এর মাধ্যমে তারা শিশু গর্ভে থাকা অবস্থায় তাকে প্রশিক্ষিত করে তোলে। বিজ্ঞান বলছে একজন শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ তার মায়ের গর্ভে থাকাকালীন অবস্থা থেকেই শুরু হতে থাকে। আবার মায়ের বিভিন্ন ইতিবাচক আচরণ গর্ভে থাকা সন্তানকে প্রভাবিত করে। যখন একজন মা গণিতের সমস্যাগুলোর সমাধান করে তখন তার মধ্যে চিন্তাশক্তি ও উদ্ভাবনী শক্তি কাজ করে, যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গর্ভের সন্তানের ভেতরেও সঞ্চারিত হয়। ফলে গর্ভাবস্থায় একজন শিশুর মেধার বিকাশ যেভাবে ঘটে অন্য জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে এই ধরনের ধারণার প্রচলন না থাকায় তাদের ক্ষেত্রে সেভাবে মেধাশক্তির বিকাশ ঘটে না। কেবল বিজ্ঞানের ধারণাকে এখানেই প্রয়োগ করা হয় না, খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে যে মেধাশক্তি বাড়ানো যায় এই বিষয়টিও মায়েদের মধ্যে কাজ করে। এই সময় মায়েরা আলমন্ড খেজুর, দুধ, রুটি, কডলিভার, মাথা ছাড়া মাছ এবং অন্যান্য বাদামযুক্ত সালাদ খেয়ে থাকে।

প্রতিটি খাদ্যই কোনো না কোনো ভাবে শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ভূমিকা রাখে। আরেকটি বিষয় এখানে লক্ষণীয়, তা হলো—মাছের মাথা বাদ দিয়ে অন্যান্য যে অংশগুলো রয়েছে সেগুলো মায়েরা খেয়ে থাকেন। এর কারণ হচ্ছে মাছের মাথা মস্তিষ্ক গঠনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। কিন্তু মাথা বাদে অন্য অংশগুলো মস্তিষ্কে পুষ্টি সরবরাহের মাধ্যমে গর্ভাবস্থায় শিশুর মেধা বিকাশে সাহায্য করে। যেকোনো খাবার গ্রহণ করার আগে তারা বিভিন্ন ধরনের ফলমূল খেয়ে থাকে। যেটিও বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রমাণিত একটি খাদ্যাভ্যাস। এখানে মায়েদের সংগীত চর্চা ও তা শোনার কথা বলা হয়েছে। বিজ্ঞানের আধুনিক ধারণা বলছে, মানুষ যখন সংগীত চর্চা করে তখন তার মধ্যে কোনো ধরনের মানসিক অস্থিরতা কাজ করে না। বরং এর পরিবর্তে মানসিক ও শারীরিক প্রশান্তি তৈরি হয়। এছাড়া পিয়ানো বাজানোর মাধ্যমে সংস্কৃতির যে চর্চা মায়েরা করে থাকে তা শিশুর সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সাহায্য করে। সংগীতের কম্পন মস্তিষ্কের কোষগুলোকে উদ্দীপ্ত করে মেধার বিকাশে সাহায্য করে। এছাড়া বিজ্ঞান, গণিত ও ব্যবসায় শিক্ষাকে জীবনমুখী করে শেখানো হয়, যাতে এগুলোর ফলাফল বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা যায়। খেলাধুলার সঙ্গেও শিশুদের সম্পৃক্ত করা হয়। বিশেষ করে দৌড়, ধনুবিদ্যা ও শুটিং এ শিশুদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। যেহেতু শুটিং ও ধনুবিদ্যার মাধ্যমে কোনো একটি লক্ষ্যকে অর্জন করতে হয়, সে কারণে এই ধরনের খেলাগুলো শিশুর মস্তিষ্ককে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে যোগ্য করে তোলে। এর সঙ্গে গবেষণাকে প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে মেধা গঠনের প্রক্রিয়া চলতে থাকে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এই জনগোষ্ঠীর সংখ্যা মাত্র ২ কোটি ৫০ লাখ হলেও বিশ্বের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তদের মধ্যে এই জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ২০ শতাংশ।

বিজ্ঞানীরা মেধা বিকাশের ক্ষেত্রে ভালো ঘুম, পুষ্টিকর খাবার, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম করার কথা বলছেন, কিন্তু উন্নত বিশ্বে এর বাইরেও বিভিন্ন প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা চলছে। বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত মার্কিন বিজ্ঞানী জেফরি সি হল, মাইকেল রসবাশ ও মাইকেল ডব্লিউ ইয়ং বায়োলজিক্যাল ঘড়ির কর্মপদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করে দেখেছেন, আমাদের ব্রেইনে একটি মাস্টার ক্লক থাকে। যেটি নিয়ন্ত্রণে থাকে বায়োলজিক্যাল ঘড়ি। মেধা বা বুদ্ধির কয়েকটি স্তর রয়েছে। অনেক বছরের গবেষণা থেকে জানা গেছে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক লোকের আইকিউ ১০০ থেকে ১১০ এর মধ্যে, যেটি একটি স্বাভাবিক অবস্থা। এই আইকিউ ১৩০ এর চেয়ে বেশি হলে মানুষ খুব বুদ্ধিমান হয়। এই ধরনের মানুষের সংখ্যা বিশ্বে ২.৫ শতাংশ। যখন এটি ১৪০ ছাড়িয়ে যায় তখন মানুষ অসীম প্রতিভাধর ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়। বিশ্বে এই ধরনের মেধাবীর সংখ্যা মাত্র ০.৫ শতাংশ। আমাদের আগামী প্রজন্মকে কীভাবে বিজ্ঞানসম্মতভাবে মেধাবী করে গড়ে তোলা যায়, সেই ব্যাপারে প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা। কেবল বিজ্ঞান নয়, শিক্ষার বহুমাত্রিকতা, দর্শন ও সংস্কৃতির প্রকৃত চর্চার মাধ্যমেও মেধাশক্তি সম্পন্ন শক্তিশালী জাতি গঠনে সবাইকে উদ্যোগী হতে হবে। 

লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

 

সৌজন্যে: ইত্তেফাক

প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036909580230713