মেধাবী জনগোষ্ঠীর বিকল্প নেই - দৈনিকশিক্ষা

মেধাবী জনগোষ্ঠীর বিকল্প নেই

ড. মো. আনিসুজ্জামান |

কয়েক দিন আগে বেড়াতে গিয়েছিলাম বোনের বাড়িতে। বোন আগেই গত হয়েছেন, বোনের স্বামী কিছুদিন আগে ইহলোক ত্যাগ করেছেন। বোনের একমাত্র ছেলে রয়েছে। ওদের দেখার উদ্দেশ্যে যাওয়া। গিয়ে দেখি ভাগ্নে, ভাগ্নেবউ বাড়িতে নেই। ওদের মেয়ে প্রার্থনা বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। কিছু সময়ের মধ্যে প্রার্থনার সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠল। প্রার্থনা মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাড়ির কাছেই বাঘবেড় উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সে। প্রার্থনা বড় হয়ে কী হতে চায়, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়তন কত বড় ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা। প্রার্থনা এরই মধ্যে আপ্যায়নও করল।

প্রার্থনাকে জিজ্ঞেস করলাম স্কুলে যায় কি না, ওদের ক্লাসের কতজন মেয়ে এবার পরীক্ষায় অংশ নেবে। প্রার্থনাদের স্কুলের অনেক মেয়ের বিয়ে হয়েছে। অনেকে বিয়ে করার পরও স্কুলে আসছে। এদের কেউ কেউ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। অনেকে বিয়ের পর স্কুলে কোচিংয়ে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশে ১৮ বছরের নিচে বিয়ে নিষিদ্ধ। তাহলে ওই মেয়েগুলোর বিয়ে রেজিস্ট্রেশন করল কে? বর্তমানে রেজিস্ট্রেশন ছাড়া বিয়ে হয় না। নিশ্চয়ই স্থানীয় কোনো কাজি অফিসে বিয়ে রেজিস্ট্রেশন হয়েছে। অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়ের বিয়ে রেজিস্ট্রেশনের দায়ে কাজির রেজিস্ট্রেশন বাতিলের রেকর্ড কম। অথচ বাল্যবিয়ে হচ্ছে। নবম-দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া কোনো মেয়ের বয়স আর যাই হোক ১৮ হতে পারে না। বাঘবেড় উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের চিত্র শুধু এটি নয়, গ্রামের বেশির ভাগ স্কুলের চিত্র একই। মিডিয়ার দৃষ্টির আড়ালে রয়েছে আমাদের বেশির ভাগ গ্রাম।

প্রার্থনা স্কুলে যায় কি না জানতে চাইলে সে জানায়, বেড়াতে ইচ্ছা করলে স্কুলে যায়। স্কুল বেড়ানোর স্থান? যাক তা-ও ভালো। স্কুলকে অন্তত এরা ভয় করে না। আমরা স্কুলে যেতে ভয় করতাম মাস্টার মশায় পিটাবেন—এই ভেবে। নালিতাবাড়ী উপজেলার তারাগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন ম্যাডামকে দেখলাম হাতে বেত নিয়ে ক্লাসে ঢুকতে। সহকারী প্রধান শিক্ষককে জিজ্ঞেস করায় তিনি জানালেন, এটা সিম্বল। উনি যে ম্যাডাম তার সিম্বল হাতে ওনার বেত রয়েছে? মাস্টারের হাতে বেত রেখে প্রমাণ করতে হবে তিনি শিক্ষক! তারাগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে আমি পড়েছি। তখন স্যারদের হাতে বেত থাকত এবং বেতের ব্যবহার যথেষ্ট হয়েছে। বর্তমানে ক্লাসে শারীরিক নির্যাতন নিষিদ্ধ। মানসিক নির্যাতনও শিক্ষার্থীদের করা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও দেখেছি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কোনো কোনো শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সীমাহীন মানসিক নির্যাতন করেন। ক্লাসে বই ছাড়া ঢুকলে বের করে দেওয়াসহ নানা অপমানজনক কথা শিক্ষার্থীদের বলেন এমন শিক্ষক কি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরল নয়?

আমরা স্কুলের কয়েকজন শিক্ষককে ভয় করতাম। স্যারদের মারের ভয় ছিল। পড়া ঠিকমতো না হলেই মার, কোনো কথা নেই। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে শিক্ষার্থীরা বেড়াতে স্কুলে যায়। ওরা শুধু বেড়াতেই স্কুলে যায়, ক্লাস করতে যায় না। কোচিং সেন্টারে, প্রাইভেটে পড়াশোনা করে। স্কুলের শিক্ষকরা কোচিং সেন্টার পরিচালনা করেন। শিক্ষকরা নিয়মিত প্রাইভেট পড়ান। মফস্বল এলাকার  বেশির ভাগ শিক্ষককেই বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত কোনো সামাজিক, পাবিরারিক অনুষ্ঠানে পাওয়া যায় না। এ সময় শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়ানো এবং কোচিং সেন্টারের ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞানের শিক্ষক হলে তো কথাই নেই। এই চিত্র শুধু মফস্বল শহরের নয়—জেলা, বিভাগীয় এবং রাজধানীতেও একই।

নতুন নতুন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। জাতীয়করণ হচ্ছে স্কুল, কলেজ। স্কুল, কলেজগুলোতে নতুন নতুন দৃষ্টিনন্দন আধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু স্কুলে যদি শিক্ষার্থী না যায়, স্কুল যদি বেড়ানোর জায়গা হয়, তাহলে বেড়ানোর জন্য কি নতুন নতুন ভবন নির্মাণ জরুরি? নালিতাবাড়ী উপজেলার একটি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানিয়েছেন, স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে থাকার জন্য। অভিভাবকরা ক্লাসে চাপ একটু কমানোর জন্য অভিযোগ করেন। কারণ ছেলেটি কিংবা মেয়েটি কোচিংয়ে যায়, বাসায় প্রাইভেট পড়ে ইত্যাদি। নালিতাবাড়ী উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলের আরো কয়েকজন প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক জানালেন, গ্রামের স্কুলগুলোর অবস্থা আরো খারাপ। গ্রামের স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতেই চায় না। তারা প্রাইভেট ও কোচিং নিয়ে থাকে। কোনো একজন প্রধান শিক্ষক জানালেন কোচিংয়ের নাম করে বাড়ি থেকে বের হয়ে নির্ধারিত সময় শেষে বাড়িতে ফেরে শিক্ষার্থীরা। শেরপুর জেলার সরকারি স্কুলের একজন শিক্ষক জানালেন, এই দৃশ্য শুধু উপজেলা পর্যায়ের গ্রামের স্কুলগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। জেলা শহরের স্কুলগুলোর চিত্রও প্রায় একই। শিক্ষার্থীরা যদি কোচিং সেন্টারে এবং প্রাইভেট পড়ে ভালো করে, তাহলে কোচিং সেন্টারের মান বৃদ্ধির দিকেই সরকারের নজর দেওয়া কি উচিত নয়? স্কুলের বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে যখন কোচিং সেন্টার দাঁড়িয়েছে তখন স্কুলের দরকার কী? সরকার তো কোচিং সেন্টার বন্ধ করতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকর্মী জানিয়েছেন, তিনি উচ্চ মাধ্যমিকের দ্বিতীয় বর্ষে মাত্র দুটি ক্লাস করেছিলেন। কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে দুটি ক্লাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে কোনো অসুবিধা হয়নি। কলেজে শিক্ষক সংকট রয়েছেই। দেখা যায় কোনো কলেজে হয়তো তিনজন শিক্ষক দিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক থেকে শুরু করে এমএ পর্যন্ত চলছে। শহর এলাকার ভালো কলেজগুলোতে নিয়োগ নিয়ে তদবির বাণিজ্য রয়েছেই। এসব কলেজের শিক্ষকদের কোচিং, প্রাইভেট বাণিজ্য অনেক বেশি।

রাজধানীর নামিদামি স্কুলের চেয়ে বিভাগীয় পর্যায়ের স্কুলগুলোর মান একটু নিচের দিকে। আবার জেলা থেকে উপজেলা পর্যায়ের স্কুলের মান খারাপ না হলেও ভালো নয়। গ্রামের উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের মান একেবারেই নিচের দিকে। অথচ সব স্কুলে একই কারিকুলাম। একই পাঠ্য বই। একই প্রশ্নে পরীক্ষার মান নির্ধারণ করা হয়। চাকরির বাজারের প্রতিযোগিতাও হয় একই মেধার মাপকাঠিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে গ্রামের শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা কোনো কোটা নেই। কিন্তু সব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান এক নয়। শহরের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গ্রামের শিক্ষার্থীদের অসম প্রতিযোগিতায় গ্রামের শিক্ষার্থীরা হারিয়ে যাচ্ছে। সবাই যে হারিয়ে যাচ্ছে তা নয়। এদের মধ্যে ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেকেই ভালো করছে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব গ্রাম ও শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে শিক্ষার মান সমান পর্যায়ে নিয়ে আসা। এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোনো মহতী উদ্যোগ চোখে পড়েনি। সরকার বিনা মূল্যে একই দিনে সারা দেশে বই সরবরাহ করছে। বই উৎসব হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের স্কুলে নিয়ে আসার উদ্যোগও সরকারকেই নিতে হবে। সরকারি স্কুল, কলেজের শিক্ষকদের প্রাইভেট এবং কোচিং বাণিজ্য নিষিদ্ধ করলে এ ব্যাপারে কিছুটা সুফল পাওয়া যাবে।

দেশের উন্নয়নের জন্য মেধাবী জনগোষ্ঠীর বিকল্প নেই। অন্য কথায় বলা যায়, মেধাবী জনগোষ্ঠীই স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের প্রধান শর্ত। দক্ষ জনশক্তি ছাড়া আমদানিনির্ভর দক্ষ জনশক্তি দিয়ে স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন শুধু রাজনৈতিক স্লোগানের মর্যাদা বৃদ্ধি করে। গ্রামের মানুষকে অন্ধকারে রেখেও উন্নয়ন সম্ভব নয়। স্বাধীনতার ৪৮ বছরে গ্রামের স্কুলগুলোর অবকাঠামোগত শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। নতুন নতুন স্কুল, কলেজ এমপিওভুক্ত হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা স্কুল ছেড়ে দিয়ে কোচিংনির্ভর শিক্ষার দিকে ঝুঁকছে। বিদ্যালয়ের চেয়ে কোচিং ও প্রাইভেট যদি উত্তমই হয়, তাহলে স্কুল, কলেজ জাতীয় করে লাভ কী? শিক্ষার্থীদের বেড়ানোর জন্য স্কুল, কলেজ কি জাতীয় করা হচ্ছে, নাকি ভোটের রাজনীতিতে সুবিধা পাওয়ার জন্য?

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0060770511627197