মেরিটাইম উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা - দৈনিকশিক্ষা

মেরিটাইম উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

সমুদ্রের যেসব সম্ভাবনা ও উপকারিতা, তা তৃতীয় বিশ্বের একটি ঘন বসতিপূর্ণ উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ; এ নিয়ে বিস্তর আলোচনার সুযোগ রয়েছে। সমুদ্রের তলদেশে অনেক মূল্যবান ধাতব পদার্থ মজুদ আছে, যার ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইলেকট্রনিক্স, সোলার প্যানেল ও টারবাইনে যেসব মূল্যবান ধাতব পদার্থ ব্যবহূত হয় এগুলো হচ্ছে রুপা, নিকেল, ম্যাঙ্গানিজ ও কোবাল্ট। বৃহস্পতিবার (২৮ নভেম্বর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। 

নিবন্ধে আরও জানা যায়, ভূপৃষ্ঠে এসব অতিপ্রয়োজনীয় ধাতব পদার্থের মজুদ প্রতিনিয়ত কমে আসছে এবং আহরণের খরচও বেড়ে চলেছে। ফলে চীনসহ অনেক উন্নত দেশ গভীর সমুদ্রে খনিজ পদার্থ কীভাবে অন্বেষণ ও সংগ্রহ করা যায়, তার জন্য গবেষণার কাজ জোরালোভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। এক গবেষণায় জানা যায়, ভূপৃষ্ঠে এসব মূল্যবান পদার্থের মজুদ আগামী ৪০ বছরে প্রায় নিঃশেষ হয়ে যাবে। তখন গভীর সমুদ্রের মজুদকৃত নিকেল ও অন্যান্য মূল্যবান ধাতব মানুষের চাহিদা মেটাবে।

উন্নত কয়েকটি দেশে বাণিজ্যিকভাবে গভীর সমুদ্রের সম্পদ আহরণের প্রযুক্তি গবেষণাগার থেকে শিগগিরই বাজারে আসার কথা শোনা যাচ্ছে। চায়নিজ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি বা ওশান ইউনিভার্সিটিতে এ নিয়ে রীতিমতো গবেষণা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাদের নিজস্ব গভীর সমুদ্রে খনিজ আহরণের আইন ২০১৬ (ডিপ সি মাইনিং ল) প্রণয়ন করা হয়েছে। জাতিসংঘে গভীর সমুদ্রের অভিভাবক (ডিপ সি অথরিটি) গঠন করা হয় ১৯৯৪ সালে। এর জের ধরে উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে চলেছে।

স্বাধীনতা অর্জনের পরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কাজ শুরু করেন। তাঁর দূরদর্শিতায় সমুদ্র বিষয়ে নতুন আইন প্রণয়ন করা হয় (দ্য টেরিটোরিয়াল ওয়াটার অ্যান্ড মেরিটাইম জোন্‌স অ্যাক্ট ১৯৭৪)। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের ষড়যন্ত্রে জাতির পিতাকে আমরা হারিয়ে ফেলি এবং তাঁর অনেক কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এর পর দীর্ঘ প্রায় সাড়ে তিন দশক সমুদ্র নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো সাফল্য অর্জিত হয়নি।

সমুদ্র সীমানা নিয়ে বাংলাদেশের দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে যে বিরোধ ছিল, তার নিষ্পত্তি না হওয়াতে সমুদ্রসম্পদ ব্যবহারে কোনো জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়নি। অবশেষে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার অসাধারণ ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে তাঁর সরকার দুই প্রতিবেশীর সঙ্গে সমুদ্র নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধ আন্তর্জাতিক আদালতে নিষ্পত্তি হয় (মার্চ ২০১২ মিয়ানমার, জুলাই ২০১৪ ভারত)। আন্তর্জাতিক আদালতে এ রায়ের ফলে বাংলাদেশে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে যায়। সরকারি পর্যায়ে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার বিষয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় আইন (২০১৩) প্রণয়ন।

এ আইনের ধারায় গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মকর্তা নিয়োগ করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির কাজ শুরু হয়। অস্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষাদানসহ স্থায়ী জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার জন্য যাবতীয় প্রশাসনিক কার্যক্রম দ্রুতগতিতে এগিয়ে যায়। সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণে চট্টগ্রামে ১০৮ একর জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পন্নের পর মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ঢাকায় স্থাপিত অস্থায়ী ক্যাম্পাসে প্রাথমিক পর্যায়ে ৬টি গুরুত্বপূর্ণ অনুষদের ১২টি বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্স চালু হয়েছে।

স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে অস্থায়ী ক্যাম্পাসকে চট্টগ্রামে স্থানান্তর করা হবে। শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য দেশ-বিদেশের ১২টিরও অধিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সংস্থার সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সম্পাদন করে বিভিন্ন পর্যায়ে একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।

পৃথিবীতে মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা খুব বেশি নেই। তবে বাংলাদেশের উভয় প্রতিবেশী রাষ্ট্রে মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় চালু করা হয় আরও আগে। মিয়ানমার ২০০২ এবং ভারত ২০০৮ সালে মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় চালু করে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় কিছুটা দেরিতে স্থাপিত হলেও সেখানে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ওশানোগ্রাফি (এনআইও) স্থাপিত হয়েছিল 'গোয়া' শহরে, ৫৩ বছর আগে (১৯৬৬)।

এ প্রতিষ্ঠানে সমুদ্র বিষয়ে অনেক উন্নতমানের গবেষণা কাজ চলছে। জানা যায়, অর্ধশতাধিক প্যাটেন্ট সেখানে ইতোমধ্যে আবিস্কৃৃত হয়েছে, যার ৬০ শতাংশ মেরিন-বায়োটেকনোলজির ওপর। আরও জানা যায়, আধুনিক প্রযুক্তি সংবলিত গবেষণার জাহাজ (রিসার্চ ভেসেল) নিয়ে বিজ্ঞানীরা নিয়মিত সমুদ্রে তাদের মূল্যবান গবেষণার কাজ করছেন।

বাংলাদেশে মেরিটাইম উচ্চশিক্ষাকে কীভাবে আরও বাস্তবতার নিরিখে উন্নত করা যায় এবং এ শিক্ষায় শিক্ষিত লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করা যায়, এ নিয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও কৌশল অবলম্বন করা দরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ভবিষ্যতে আরও উন্নত পর্যায়ে নিতে হলে স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠানের বর্তমান সামর্থ্য, দুর্বলতা, সুযোগ ও সম্ভাবনা এবং অন্যান্য হুমকি বিবেচনায় রেখে সম্ভাব্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নে সঠিক, জোরালো পদক্ষেপ ও কৌশল গ্রহণ করতে হবে।

সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় মেরিটাইম শিক্ষপ্রতিষ্ঠানগুলোকে জাতির উন্নয়নে রূপকল্পের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলার পথে আরও নতুন নতুন উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, পররাষ্ট্র্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট ও পাওয়ার এনার্জি অ্যান্ড মিনারেল রিসোর্স ডিভিশনের অন্তর্ভুক্ত 'ব্লু ইকোনমি সেল'। ব্লু ইকোনমি সেলের বিস্তারিত কার্যক্রম এখনও শুরুর অপেক্ষায়। অনেক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এদের কার্যক্রম জড়িত বিধায় এ সেলের সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পরিচালিত হলে আরও দক্ষতার সঙ্গে কার্য সম্পাদন সম্ভব বলে মনে হয়। তবে মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে গৃহীত পদক্ষেপের মধ্যে যে বিষয়গুলো অধিক কার্যকরী ও ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখতে পারবে বলে ধারণা করা হয় তা হচ্ছে :মেরিটাইম সংশ্নিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন মেরিন একাডেমি, ফিশারিজ একাডেমির স্নাতক কোর্স মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্তি; সংশ্নিষ্ট আইনে বিদেশি শিক্ষক ও বিশেষজ্ঞ নিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি; বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি সমন্বয়ে সিনেট, সিন্ডিকেট গঠন; সম্পূূর্ণ মেধার ভিত্তিতে কর্মকর্তা ও শিক্ষক নিয়োগ এবং তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা; ট্রেনিং অব দি ট্রেইনার (টিওটি) অর্থাৎ প্রশিক্ষকের প্রশিক্ষণ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ; মেরিটাইম উচ্চশিক্ষার প্রাথমিক পর্যায়ে যেসব বিষয়ে শূন্যতা বা ঘাটতি রয়েছে, সেগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিতকরণ ও সে বিষয়ে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে :বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষকের ঘাটতি পূরণ; আধুনিক যন্ত্রপাতি সংবলিত ল্যাবরেটরি ও উপকরণ সংগ্রহ; রিসার্চ ভেসেল ও ট্রেনিং জাহাজ বন্দোবস্তকরণ।

আমরা জানি, মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় নৌবাহিনীর অভিজ্ঞ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এবং অভিজ্ঞ অধ্যাপক সমন্বয়ে গঠিত দলকে বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এর ফলে প্রাথমিক পর্যায় থেকেই কর্মক্ষেত্রে সুফল পাওয়া যাচ্ছে। তবে অভিজ্ঞ অধ্যাপকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে এবং সংশ্নিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারের সহযোগিতা বজায় থাকলে আশা করা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় অচিরেই আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হবে।

একটা বিষয় মনে রাখা দরকার, যত্রতত্র বিশেষায়িত বিভাগ না খুলে মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের একই ছাতার নিচে ছোট ছোট মেরিটাইম ইনস্টিটিউট নিয়ন্ত্রিত থাকলে শিক্ষার মান বৃদ্ধি সম্ভব। কেননা, সীমিত সম্পদ অনিয়ন্ত্রিত সংখ্যক প্রতিষ্ঠানে ভাগাভাগি করলে কোনো স্থানেই কার্যকরী শিক্ষাব্যবস্থা বজায় রাখা সম্ভব হবে না। বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে নিজস্ব বিশেষজ্ঞ তৈরির দায়িত্ব জাতিকে নিতে হবে। নতুবা কষ্টার্জিত সমুদ্র বিজয়ের সুফল বিদেশি বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে আমাদের হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।

লেখক : এএসএম আব্দুল বাতেন, রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.); সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ।

প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0037081241607666