মোবাইল খরচ বৃদ্ধি নিয়ে অসন্তুষ্ট গ্রাহকেরা - দৈনিকশিক্ষা

মোবাইল খরচ বৃদ্ধি নিয়ে অসন্তুষ্ট গ্রাহকেরা

নিজস্ব প্রতিবেদক |

মহামারীর এই সময়ে যখন পারস্পরিক যোগাযোগ, লেখাপড়া ও ব্যবসা-বাণিজ্য মোবাইলে কথা বলা ও অনলাইনভিত্তিক হয়ে উঠছে, সেই সময়ে এই সেবার ওপর কর বৃদ্ধি গ্রাহকের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বৃহস্পতিবার সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের যে বাজেট প্রস্তাব করেছেন তাতে মোবাইল সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

এর ফলে মোবাইল ফোনে কথা বলা, এসএমএস পাঠানো এবং ডেটা ব্যবহারের খরচ বেড়েছে। বাজেটে ঘোষণা আসার পর এনবিআর এসআরও জারি করায় বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকেই বাড়তি হারে টাকা কাটা শুরু করেছে দেশের মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো।

এখন মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কেউ যদি ১০০ টাকার সেবা নেন তাহলে তিনি ৭৫ দশমিক শূন্য ৩ টাকার সেবা পাবেন। বাকি ২৪ দশমিক ৯৭ টাকা যাবে সরকারের পকেটে।

ডিনরসিংদীর গৃহিণী নাজমুন্নাহারের পরিবারের আট সদস্যের ছয়জনই থাকেন ঢাকায়। তাদের সঙ্গে নিয়মিত মোবাইলে যোগাযোগ করেন তিনি।

মোবাইল ফোনে খরচ বাড়ায় পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ নিয়ে চিন্তিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী শাহরিমা জাহান শর্মি।

তিনি বলেন, “বাবার বাড়ি ও শ্বশুর বাড়িতে নিয়মিতই ভিডিওকলে যোগাযোগ করি। মোবাইলেও অনেক সময় কথা বলতে হয়। এভাবে যোগাযোগ মেইনটেইন করা তো খুব জরুরি। কিন্তু ব্যয় বাড়লে ডেটা ব্যবহার কমাতে হবে। অতি প্রয়োজনীয় যোগাযোগটাও আগের মতো থাকবে না।”

মোবাইলের খরচ বাড়িয়ে গ্রাহকের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করাটা ‘মোটেও ঠিক হয়নি’ বলে মন্তব্য করেন এই শিক্ষার্থী।

বাজেটে মোবাইল ফোন ব্যবহারে খরচ বৃদ্ধির বিষয়টা না হলেই ভালো হত বলে মন্তব্য করেন ঢাকা সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. জাফর ইকবাল।

তিনি বলেন, “যোগাযোগের মাধ্যমগুলো সহজলভ্য হওয়া উচিত। দেশের এই করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউনের সময়টায় যোগাযোগের ক্ষেত্রে মোবাইল ফোন একমাত্র মাধ্যম ছিল।এখনকার পরিস্থিতিতে অল্প দূরত্বেও কথা বলার জন্য মোবাইল ব্যবহার করতে হয়।”

এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়ে কৃষি ও পোল্ট্রি উদ্যোক্তা জুয়েল মাহমুদ বলেন, “মানুষ যখন প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকছে, ইন্টারনেট ব্যবহার বাড়াচ্ছে তখন সরকার ইন্টারনেট, মোবাইলের কল, সিম কার্ডের খরচ বাড়িয়ে দিল। দেশ যদি ডিজিটাল বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যায় তাহলে এসবের খরচ বাড়বে কেন? তাহলে কিসের ডিজিটাল বাংলাদেশ?

“মোবাইল খরচ বাড়ানোটা সাধারণ মানুষের গলায় ছুরি চালানোর মতো হইছে। এমনিতে সাধারণ মানুষের জীবন যায় যায়। সেখানে এমন অপরিহার্য সেবার ওপর চাপ বাড়ায় বাজেট কোনো উপকারে আসবে না।”

ঢাকার রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজেরে ষষ্ঠ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর বাবা হাসনাইন জানান, গত প্রায় এক মাস ধরে তার ছেলের ক্লাস হচ্ছে অনলাইনে। পরীক্ষাও হচ্ছে। সে কারণে ছেলের জন্য একটি স্মার্টফোন কিনতে হয়েছে। ছেলেকে সব সময় অনলাইনে থাকতে হচ্ছে, লেখাপড়ায় কোনো ‍কিছু বুঝতে সমস্যা হলে সেখানেই শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে নিচ্ছে।

“এখন খরচ বেড়ে গেল। করোনার কারণে এমনিতেই অনেকের আয় কম গেছে, সেখানে সব দিক মিলিয়ে আমাদের এটা এখন মরার উপর খাঁড়ার ঘা।”

ওই কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল ড. মো. নূরুন নবী জানান, তারা প্রায় এক মাস ধরে অনলাইনে রুটিন অনুযায়ী ক্লাস নিচ্ছেন। যথারীতি পরীক্ষাও চলছে। একটি ফেইসবুক পেইজ খোলা হয়েছে, যেখানে ৫ হাজার ১২৬ জন শিক্ষার্থী যুক্ত আছে। অস্বচ্ছল যেসব শিক্ষার্থীর স্মর্টফোন নেই তাদের কাছ থেকে আবেদন চাওয়া হয়েছে। পরে তা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।

তিনি জানান, তাদের মতো রাজধানীতে আরও একটি কলেজে অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষা শুরু হয়েছে। আবার কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস শুরুর চেষ্টা চলছে।

বুয়েটেও অনলাইনে পরীক্ষামূলক ক্লাস শুরু হয়েছিল। পরে তা আর অব্যাহত থাকেনি। আবার রাজধানীর কিছু কিছু কোচিং সেন্টার কলেজ ভর্তিতে সহযোগিতার জন্য অনলাইনে ক্লাস শুরু করেছে। এই সময়ে মোবাইল খরচ বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে ভাবতে হচ্ছে বলে জানান সদ্য মাধ্যমিক পাশ করা শিক্ষার্থী আনিশা।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে কুড়িগ্রামে অবস্থান করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ফাতিহা আলমও মনে করেন, মোবাইল ডেটা ব্যবহারে খরচ বাড়লে কিছুটা অসুবিধায় পড়তে হবে তাকে।

একটি আবাসন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক খালিদ হাসান বলছেন, করোনাভাইরাস সংকটের মধ্যে মোবাইল ফোন ব্যবহারে ব্যয় বাড়ানো ‘কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত হয়নি’।

“এই সময়ে আমরা অনেক বেশি মোবাইলনির্ভর হয়ে পড়েছি। আমি যেহেতু নির্মাণ সংস্থার ব্যবস্থাপনার কাজ করছি তাই আমাকে সব সময় ক্লায়েন্টদের সাথে ফোনেই যোগাযোগ করতে হয়। এক্ষেত্রে কলরেটের খরচ যদি বেড়ে যায় তাহলে সবার জন্যই কঠিন হবে।

“যদি মহামারী না হত তাহলে হয়ত মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু যেহেতু একটি কঠিন সময় যাচ্ছে সবার জন্য, তাই এটি সরকারের পুনর্বিবেচনা করা উচিত।”

রংপুরের বস্ত্র ও হস্তপণ্যের নারী উদ্যোক্তা ছাদেকুন্নাহার বলেন, “মানুষের চলাচল সীমিত হাওয়ার কারণে ব্যবসা এখন ইন্টারনেটনির্ভর হয়ে উঠছে। অনলাইনে অর্ডার দিচ্ছে। মোবাইল ফোনেও ক্রেতাদের সাথে যোগাযোগ করতে হচ্ছে।

“আমরা স্বল্প পুঁজির মানুষ, খরচ বাড়লে ব্যবসা চালানোও কঠিন হবে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য মোবাইল ফোনের খরচ বাড়ানো বাড়তি চাপের হল।”

গণমাধ্যমকর্মী ও ইউটিউব কনটেন্ট নির্মাতা রশিদ আল রুহানী বলেন, “মোবাইলের খরচ বাঁচাতে ওয়াই-ফাই দিয়েই সব কাজ করার চেষ্টা করি। কিন্তু সব সময় তো বাসায় থাকি না। অনলাইনে টুকটাক বিক্রির কাজও করি। এগুলো তো বাইরে থাকলে মোবাইলেই দেখতে হয়। এখন খরচ বাড়লে আরও বেশি বাসায় থেকে কাজ করতে হবে। ওয়াই-ফাই নির্ভরতা বাড়াতে হবে।”

তিনি বলেন, “উন্নত রাষ্ট্রগুলো কলরেট, ইন্টারনেট খরচ ক্রমেই কমিয়ে আনছে। তারা বোঝেন যোগাযোগ ব্যবস্থা যত সহজ হবে ততই কর্মক্ষেত্রে সহজে জায়গা করে নেবে মেধাবী উদ্যোক্তারা, যা দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখবে। কিন্তু আমাদের দেশ উল্টো হাঁটছে।

“বাড়তি শুল্ক বসিয়ে উদ্যোক্তাদের বাধা দিয়ে, যারা ফ্রিল্যান্সিং করে, অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কাজ করে দেশে রেমিটেন্স আনে তাদের বিপদে ফেলে সরকারই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশে যখন যে সেক্টর এগিয়ে যেতে চায়, তার ওপরই চাপ দেওয়া হয়। তার উদাহরণ ই-কমার্স। সারা বিশ্ব যেখানে অনলাইন কেনাকাটা সহজ করছে, সেখানে আমরা চাপ প্রয়োগ করছি।”

মোবাইল ব্যবহার এখন ঐচ্ছিক নয় বলে মন্তব্য করেন জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার কমিউনিকেশনস অ্যাসিস্ট্যান্ট ওয়াহিদা জামান সিঁথি। তিনি বলেন, “রাস্তাঘাটে বের হলে ইন্টারনেটের জন্য মোবাইল ডেটাই ব্যবহার করা হয়। আবার সবার বাসায় ব্রডব্যান্ড সংযোগও থাকে না। ফলে মোবাইলে সিমের মাধ্যমে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই বাড়তি খরচে গ্রাহকদের জন্য অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।”

কলরেট বাড়ালেও ডেটার মূল্য কমিয়ে তা সাধারণ মানুষের আরও নাগালে আনা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

দেশে বর্তমানে চারটি মোবাইল অপারেটর রয়েছে। গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি ও টেলিটক। এই অপারেটরগুলোর সর্বশেষ গত মার্চের হিসাব অনুযায়ী, মোট গ্রাহক সংখ্যা ১৬ কেটি ৫৩ লাখ ৩৭ হাজার। এদের মধ্যে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন ১০ কোটির মতো গ্রাহক।

বর্ধিত শুল্ক প্রত্যাহার না করলে গ্রাহকরা বিকল্প পথে হাঁটতে পারে বলে শঙ্কা করছেন মোবাইল গ্রাহক এসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ।

তিনি শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেন, “মহামারীতে বহু গ্রাহক স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঘরে বসে কাজ করছে। অন্যান্য দেশ গ্রাহকদের নিরবচ্ছিন্ন, দ্রুত গতির ইন্টারনেট সাশ্রয়ী মূল্যে প্রাপ্তিতে কাজ করে যাচ্ছে। সে সময়ে আমাদের ডিজিটাল সরকার মোবাইল সেবায় সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে। আয় রোজগারহীন গ্রাহকের ওপর অতিরিক্ত করের বোঝা জুলুম।

“সরকারকে ভাবতে হবে, অতি দরিদ্র ব্যক্তি বা পরিবার যারা বর্তমানে উপার্জনহীন তাদের থেকে উচ্চ কর আদায় কতটুকু সমীচীন হবে। এ সেবায় এমনিতেই নৈরাজ্য চলছে, তার ওপর অতিরিক্ত কর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়াবে।”

শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন মোবাইল ফোন অপারেটরদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশের মহাসচিব এস এম ফরহাদও।

তিনি বলেন, “দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে এমনিতেই মানুষের মধ্যে যখন নাভিশ্বাস উঠেছে, মোবাইল মাধ্যম হয়ে উঠেছে সব যোগাযোগের মূল চালিকা ও দেশ ডিজিটাল ইকনোমির দিকে এগিয়ে চলছে; ঠিক সে সময় এ ধরনের করের বোঝা কোনোভাবেই দেশের অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক হবে না।

“এ বোঝা দরিদ্র মানুষের জন্য অসহনীয় হয়ে পড়বে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পথে অন্তরায় হয়ে উঠবে, যা করোনাভাইরাস সঙ্কটের কারণে আরও বাড়বে।”

ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার - dainik shiksha মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036551952362061