জনসাধারণের বড় একটি অংশ করোনা সংক্রমণের ব্যাপারে উদাসীন। তাঁরা স্বাস্থ্যবিধি মানেন না, মাস্ক পরেন না, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ান। সরকার এই জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করতে পারেনি। রোববার (১২ জুলাই) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, যাঁরা কর্মজীবী, যাঁদের বাড়ির বাইরে যেতে হয়, তাঁরা মানুষের সঙ্গে শারীরিক দূরত্ব মানার চেষ্টা করবেন। বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক পরবেন, কর্মস্থলে ঢোকা ও বের হওয়ার সময় ভালো করে হাত ধুয়ে নেবেন। বাসায় আসার পর গোসল করে নেওয়া ভালো, পরিবারের অন্য সদস্যদের থেকেও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। এসব না হলে এখন যেভাবে চলছে সেভাবে চললে জুলাইয়ে সংক্রমণ কমার আশা দুরাশাই থেকে যাবে।
আবার করোনাকালে আমাদের স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির চিত্রও প্রকটভাবে প্রকাশিত হয়েছে। করোনা শনাক্তের ভুয়া প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে, চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতালের দৌরাত্ম্য রয়েছে—মোট কথা এই খাতের সর্বস্তরেই দুর্নীতি আছে। এখন শর্ষের মধ্যেই যদি ভূত থাকে, তবে ওই শর্ষে দিয়ে তো আর ভূত তাড়ানো যাবে না। তাই সবার আগে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি জনসাধারণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, আর না মানলে প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে, যাতে তারা স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিদেশি কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বলছে, গত জুন মাস ছিল আমাদের দেশে করোনা সংক্রমণের ‘পিক’ সময়। আমিও এর সঙ্গে একমত। দেশে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর তথ্য পর্যবেক্ষণ করে এমন আভাস পাওয়া যায়। কয়েক দিন থেকেই আক্রান্তের হার প্রায় একই রকম থাকছে, আবার মৃত্যুর হারও আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। এমন অবস্থায় আমি আশা করি, চলতি মাসের শেষ দিকে দেশে আক্রান্তের সংখ্যা কমে আসবে। কিন্তু এর পুরোটাই নির্ভর করছে সরকারের কার্যক্রম আর জনসাধারণের স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপর।
সামনেই ঈদুল আজহা। মূলত এই ঈদে শহরের মানুষের গ্রামের বাড়ি যাওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে। কিন্তু এবারের ঈদটি অন্য সময়ের মতো নয়। গত ঈদে আমরা দেখেছি প্রথমে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হলো ঢাকা ছাড়া যাবে না, পরে বলা হলো ব্যক্তিগত গাড়িতে যাওয়া যাবে। এতে দলে দলে মানুষ ঢাকা ছাড়ল, গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল করোনাভাইরাস। আসছে ঈদেও যদি এমন হয়, তবে করোনা নিয়ে কোনো ভবিষ্যদ্বাণীই ফলবে না। করোনার সংক্রমণ আবার বাড়বে।
এমন অবস্থায় যে যেখানে আছেন, সেখানে থেকেই এবার ঈদটি উদযাপন করতে হবে। মানুষ যাতে দলে দলে ঢাকা ছাড়তে না পারে, প্রশাসনকেও সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
এখন প্রশ্ন এসেই যায়, যে যেখানে আছেন সেখানেই থাকলে কোরবানির কী হবে? হাট কি বসবে? আসলে কোরবানির সঙ্গে ধর্মীয় বিধানের পাশাপাশি বহু মানুষের জীবন-জীবিকা ও দেশের অর্থনীতির বিষয়টি জড়িত। তাই কোরবানি বন্ধ করা যাবে না। হাটের সংখ্যা সীমিত করে অবশ্যই সেখানে ক্রেতা-বিক্রেতাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে পশু কেনাবেচা নিশ্চিত করতে হবে। শহরে এটি একটু কঠিন, কিন্তু গ্রামীণ এলাকায় এটি সম্ভব। তাই শহরে যাঁরা আছেন তাঁরা সম্ভব হলে এবার কোরবানির পশু কেনার টাকা গ্রামে পাঠিয়ে দিতে পারেন। গ্রামের আত্মীয়স্বজন পশু কিনে কোরবানি দিয়ে দেবেন। আর যাঁদের একান্তই সম্ভব নয়, তাঁরা ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে কোরবানি দিতে পারেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পশু কেনা থেকে জবাই পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। পশু কেনাবেচায় অনলাইন হাটের আয়োজনও এ ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। মনে রাখতে হবে সবার আগে জীবন। তাই শহরে পশুর হাট বসানোর আগে সেখানে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে, প্রশাসনকেও এ ব্যাপারে কঠোর হতে হবে।
আমরা এমন এক পরিস্থিতিতে আছি, কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছি না, কত দিন পর করোনা নির্মূল হয়ে যাবে। তাই জীবন ও জীবিকাকে একেবারে স্তব্ধ করা যাবে না। দিনের পর দিন মানুষকে ঘরবন্দী করেও রাখা যাবে না। এমনও হতে পারে যে করোনাকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের চলতে হবে। এমন অবস্থায় সচেতন হতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি মানাকে নাগরিক দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। নিজের, পরিবারের ও দেশের স্বার্থেই এটি করতে হবে। এটি করলে নিজেও ভালো থাকা যাবে, পরিবারের সদস্যসহ অন্যদেরও সুস্থ রাখা যাবে।
লেখক : এ বি এম আবদুল্লাহ, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইউজিসি অধ্যাপক।