যেভাবে শিশু আত্মবিশ্বাসী হতে পারে - দৈনিকশিক্ষা

যেভাবে শিশু আত্মবিশ্বাসী হতে পারে

সালেহা চৌধুরী |

শুরু করতে হবে প্রথম থেকে। যখন সে পেটে, যখন সে দোলনায়। মা যখন গান শোনেন, পেটের শিশু তা উপভোগ করে। শিশু যখন পেটে, মায়ের খাবার ও পানীয় সবকিছুতেই চিন্তা থাকতে হবে। এরপর যখন ও দোলনায়, তখনও ওর চিন্তা নিয়ে ভাবতে হবে। একে ইংরেজিতে বলে 'আর্লি স্টার্ট'। অনেক আগে থেকে শুরু করা।

২. বই পড়ে শোনাতে হবে। ছোট শিশুর জন্য পশ্চিমে কাপড়ের বই পাওয়া যায়। যদিও শিশু সবসময় সব বোঝে না, তবু পড়তে হবে। বই ভালোবাসা মানে অনেক কিছু।

৩. শিশুর সঙ্গে কথা বলতে হবে। ওরে আমার সোনারে, বাবুরে, কলিজারে বলে যত কথা বলা যায়, তত ভালো। অনেক গল্প করতে হবে। আকাশ, বাতাস, তারাদের গল্প। বাবার গল্প। মুক্তিযুদ্ধের গল্প। বীরের গল্প। 

৪. যখন সে খেলবে, পড়বে, কথা বলবে, তার সঙ্গে 'ইন্টার অ্যাক্ট' করতে হবে।

৫. খেলনা যেন খুব দামি না হয়। ভাঙার ভয় না করে সে যেন মনের আনন্দে খেলতে পারে। বাড়িতে বানানো পুতুল, জুতার বাক্স, এমনি কিছু সাধারণ জিনিস। আর পুতুল কেবল মেয়েদের জন্য নয়, ছেলেরাও খেলবে। 'ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুর অন্তরে।' রান্না কেবল মেয়েদের নয়, ছেলেদেরও।

৬. শিশুকে তাড়াতাড়ি পড়তে শেখাতে হবে এবং বইমুখী করতে হবে। বিদেশে বিবিধ বয়সের শিশুদের জন্য কত রকমের বই যে পাওয়া যায়, তার ঠিক নেই। আমাদের দেশে যার অভাব আছে। মায়েরা ছবি দিয়ে বই বানাতে পারেন। বয়স চিন্তা করে বই কেনা ভালো। 

৭. যখন সে খেলবে, সেখানে যেন সামাজিক ভাবনা ও ভাব প্রবণতার জায়গা থাকে এবং সঙ্গে সঙ্গে যেন বুদ্ধির বিকাশ হয়। মানসিক বিকাশ হবে এসবে।

৮. ওদের হাঁটাচলা, এক্সারসাইজের যেন সুযোগ থাকে। বাড়িতে জায়গা নেই? স্কিপিং, হুলাহুপ, কাঠের বাক্সে ওঠানামা। এ ছাড়া বাইরে নিয়ে হাঁটাহাঁটি। পার্ক, মাঠ। এতে শরীরের রক্ত চলাচল ভালো হয়। ব্রেনের সেলগুলো খাবার পায়। খেলতে খেলতে বা ব্যয়াম করতে করতে যেন নেয়ে-ঘেমে ওঠে। অ্যাপার্টমেন্টের শিশুদের জন্য ভাবতে হবে।

৯. ওদের যদি কোনো ক্রিয়েটিভ অভ্যাস থাকে, তাকে সাহায্য করা। উৎসাহিত করা। সৃষ্টিশীল অভ্যাসকে লালন করা। সে যাই হোক। সাবান দিয়ে পুতুল বানানো বা গান বানানো বা লেখালেখি বা কাগজের নৌকা বা অরিগামি কিংবা ইকিবানার ফুল।

১০. গান ওদের জীবনের অন্যতম একটি বিনোদন হতে পারে। শুনবে, গাইবে।

১১. টিভি দেখা কমিয়ে দিতে হবে। অন্য অভ্যাস যেন থাকে। আজেবাজে যা পেল, তাই দেখল- এটা ভালো নয়। 

১২. শিশুকে বোঝাতে হবে, মা-বাবাও অনেক স্মার্ট। তারা অনেক কিছু পারে। রান্না, বাজার ওদের জন্য খেলনা, বই বানানো। আরও কত কী? ওরা যেন মা-বাবাকে নিয়ে গর্ব করতে পারে। মনে আছে দুটি বাচ্চার ঝগড়ার কথা? কার মা কত বেশি পারে বলতে বলতে যখন আর কিছু বলার ছিল না, তখন একটা বাচ্চা বলে- মাই মাম ইজ ফ্যাটার দেন ইয়োর মাম। 

১৩. কিছু স্মার্ট কম্পিউটার গেম জীবনে থাকতে পারে। যেখানে অক্ষর, অঙ্ক, গান সবকিছু থাকে। ধ্বনিও কম্পিউটার শেখাতে পারে, যাকে বলা হয় 'ফোনিম'। 

১৪. যখন ওরা বলবে- আমি বোরড। কী করব জানি না, তখন চুপ করে দেখতে হবে এই বোরড্‌ম থেকে রক্ষা করতে ওরা কী করে? বকা না দিয়ে দেখা।

১৫. কোনো কিছুর জন্য ঝুঁকি বা রিস্ক নেওয়া শেখাতে হবে। চেষ্টা করা, তারপর হবে, না হলে হবে না।

১৬. কোনো সমস্যার নিজে নিজে সমাধান করার চেষ্টা করা। সব সমস্যার সমাধান করে দিলে তো ওরা কিছুই পারবে না। প্লিজ, স্টপ স্পুন ফিডিং। 

১৭. আই ক্যান ডু, আমি করতে পারি। এটা যেন ওরা বলতে ভয় পায় না। আমার মনে আছে- নার্সারির বাচ্চা যখন বলে, আই ক্যান ডু ইট। সেদিন তার আনন্দের দিন। কোট পরতে বা জুতার ফিতা নিজে লাগাতে পারছে।

১৮. বাচ্চা সম্বন্ধে কখনও নেতিবাচক মনোভাব থাকা ভালো নয়। সেটা নিয়ে অন্যের সঙ্গে আলোচনা বাচ্চার সামনে নয়। ওদের বলা- ইউ ডোন্ট হ্যাভ টু বি বেস্ট ইন দ্য ক্লাস। বাট ট্রাই ইয়োর বেস্ট। ফার্স্ট হতে না পারলে জীবন শেষ, এমন মনোভাব যেন না থাকে।

১৯. খাওয়াতে হবে ঠিকমতো। একটা সিদ্ধ ডিম, পরিজ সিরিয়াল সকালে। ফল খাবে প্রচুর। কমলার রস পান করবে। যেদিন মাছ, সেদিন মাংস নয়। তবে সকালের খাবার একেবারে চমৎকার হতে হবে। যে শিশু সকালে ভালো নাশতা করে, সে খুব মনোসংযোগী হয়। 

২০. দেখতে হবে ওর যেন পরিমাণমতো ঘুম হয়। বাচ্চার বড় হওয়ার জন্য, ব্রেনের জন্য এই ঘুম প্রয়োজন।

২১. একটা গোল যেন সামনে থাকে। একটা ছবির বই বানানো বা নিজে নিজে একটা গেম বানানো বা কাঠের বাক্স দিয়ে ঘর বানানো। সময় নিয়ে, একটু একটু করে।

২২. প্রশংসা করতে হবে, তবে অতিরিক্ত নয়। অতিরিক্ত প্রশংসা ওদের নার্সিসিজমে আক্রান্ত করতে পারে। ভালো কাজের প্রশংসা দরকার।

২৩. বাচ্চাকে বলা, ভবিষ্যতে ও কী হতে পারে। ওর সম্ভাবনার কথা। তবে এমন কিছু বলা ঠিক নয়- আমি ওকে ডাক্তার বা জজ বানাব। ওদের ভাবতে দিতে হবে, ওরা কী হতে চায়। 

২৪. ছোটখাটো প্রাইজের ব্যবস্থা করলে কেমন হয়? একটা খেলনা, বই, বল, পছন্দের জামা, সিডি, ডিভিডি যেমন পছন্দ। এতে উৎসাহ বাড়বে বৈ কমবে না।

২৫. ওদের পছন্দের যেন রকমফের থাকে। ওরাই ঠিক করবে, এখন ওরা কী করতে চায়। তবে অনেক সময় হাত ধরে ঠিক পথে নিয়ে যেতে হয়; তবে অনেক কায়দা করে।

২৬. সবসময় কন্ট্রোল করার চেষ্টা নয়। পরিণাম ভয়াবহ হয়ে যেতে পারে। ব্রিটেনে একটি মেয়েকে বাবা কন্ট্রোল করতেন। তার শিশুকাল বলে কিছু ছিল না। অক্সফোর্ডে যাওয়ার পর মেয়েটা দেহ ব্যবসা শুরু করে। 

২৭. মানবতা শেখানো। পারলে কাজের লোকটাকে পড়ানো। একজনকে রাস্তা পার করতে সাহায্য করা। দোকানের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আর একজনকে বের হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। ধর্মই মানবতা।

২৮. এমন চাপ দেওয়া ঠিক নয়, শিশু যেন স্ট্রেসফুল না হয়ে যায়। 

২৯. বাড়ির কাজে একটু সাহায্য করল। রান্নাঘরে, টেবিল সাজানোয়, কেউ এলো, ধোয়া-মোছায় ও বাড়ি পরিস্কার। বাড়ির চারপাশ পরিস্কার। প্রতিবেশীকে জানা। কথা বিনিময়। শিশুকে সামাজিক করে তোলা। 

৩০. বাবার সঙ্গে যেন ভালো সম্পর্ক হয়। যে শিশুর বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো, সে অপরাধ কম করে। এটা হলো গবেষকদের কথা।

৩১. একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।

৩২. বাচ্চাকে গল্প বলা। তারপর ওদের বলা- তুমি একটা গল্প করো। বই পড়ার পর সেই বইয়ের গল্প নিজের মতো করে বলা।

৩৩. অঙ্ককে যত সহজ করে শেখানো যায়, তত ভালো। তেমনি ব্যাকরণে বিভীষিকা যেন না থাকে। ইংরেজি লেখার আগে বলা শেখানো। 

৩৪. ওকে কাছে নিয়ে বলা, ভবিষ্যতে ও কী হতে পারে, কী করতে পারে। খুব বেশি নয়। কারণ একদিন ও বলবে, নিজের ভবিষ্যতের কথা।

৩৫. নানা সব মজার ম্যাজিক্যাল সিনেমা বাচ্চার সঙ্গে শেয়ার করা। হ্যারি পটারও হতে পারে বা আলাদিনের গল্পও হতে পারে। বইমেলায় যাওয়া, পছন্দের বই কেনা। সারাবছর বই কেনা। ঈদে-পরবে ভালো জামার সঙ্গে একটি-দুটি বই কেনা যেতে পারে।

৩৬. সবকিছুর পরে নিজের ভালো লাগার একটা কিছু যেন সে করতে পারে।

৩৭. শিখতে হবে কাজ করে। বাড়ির লাইট যেন লাগাতে পারে। ফিউজ চেঞ্জ যেন করতে পারে। অনেক কাজ করতে পারার মতো মনোবল থাকতে হবে।

৩৮. প্রাইভেট টিউটর? খুব বেশি হলে যা বললাম, সেসব করানো মুশকিল। বাবা-মায়ের ওপর ছেড়ে দেওয়া ভালো। প্রাইভেট টিউটরের পরে কী করা যায়। 

৩৯. প্রতিদিন যেন একটা কিছু শেখে। সুডোকো, ক্রসওয়ার্ড পাজল, ওয়ার্ড সার্চ। আরও কত কী। ছবি কেটে বই বানানো। 

৪০. প্রকৃতির কাছে মাঝেমধ্যে যাওয়া। নানাবাড়ির গ্রামে। ব্রিটেনের শিশুরা বছরে একবার খামারে গিয়ে কিছু সময় কাটিয়ে আসে। মাইকেল মোরপারগোর বিশাল খামার আছে। তিনি কেবল শিশুদের বই লেখেন না। শিশুদের সঙ্গে প্রকৃতির সংযোগ ঘটান। সেখানে শিশুরা চাষবাস, দুধ দোয়া, মুরগির ডিম সংগ্রহ সবকিছু করে। সে এক মজার অভিজ্ঞতা। তিনি এ কারণে গ্রামে থাকেন। অসাধারণ এই লেখক।

৪১. বাচ্চাদের কবিতা মুখস্থ করানো। এ নাকি ব্রেনের জন্য ভালো। কবিতা মুখস্থ করানোয় শিশুদের আত্মবিশ্বাস বাড়ে বলে গবেষকদের অভিমত। 

অনেকেই উপরোক্ত কথাগুলো বলেছেন। সবার নাম দিলে রচনা অনেক বড় হয়ে যাবে। তাই সবার নাম দিলাম না। আমি কর্মজীবী মা ছিলাম। এতকিছু বাচ্চাদের নিয়ে করতে পারিনি। এখন ভাবি তাই। আশা করি, আপনারা করবেন এবং পারবেন। 

 

লেখক: ব্রিটেন প্রবাসী কথাসাহিত্যিক

 

সৌজন্যে: সমকাল

প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0083310604095459