যৌন নির্যাতন প্রতিকারের উপায় কী - দৈনিকশিক্ষা

যৌন নির্যাতন প্রতিকারের উপায় কী

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

পরশু কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে চোখে পড়ল, পথচারী একটি মেয়ের উদ্দেশে তিন মোটরসাইকেল আরোহী বাজে অঙ্গভঙ্গি করছে। রিকশা থামিয়ে কী হয়েছে জানতে চাইলে ওরা আমাকেও নোংরা কথা বলতে শুরু করল। শেষে প্রক্টরকে ফোন করেছি শুনে চলে গেল। বাসায় ফিরে আমার কর্তাকে ঘটনাটি বললে প্রথমে বিশ্বাসই করতে চায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে কোনো ছাত্রী বা শিক্ষকের সঙ্গে এ রকম অশোভন আচরণ কেউ করতে পারে বলে তাঁর ধারণাই নেই। সঙ্গে সঙ্গে কলেজজীবনের এক ঘটনা মনে পড়ে গেল। আমার খুব ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুকে তার খালু শারীরিক নির্যাতনের চেষ্টা করেছিল। খালার সহযোগিতায় সে রক্ষা পায়। পরে অবশ্য খালা বেচারি পতি দেবতার(!) সম্মান বাঁচাতে ঘটনা অস্বীকার করেন। এবং যথারীতি ওর মা-বাবাও বিশ্বাস করেননি, বরং সম্মানীয় স্বজনকে ভুল বোঝার জন্য তিরস্কার শুনতে হলো তাকে। অথচ বন্ধু হয়ে আমরা বুঝেছি, ওর সজল চোখ ভুল বলেনি। সেই একটি অবিশ্বাস তার সব বিশ্বাসকে নষ্ট করে দিয়েছে। এরপর এ রকম আরো ঘটনার মুখোমুখি হলেও মা-বাবাকে আর বলতে যায়নি। পুরুষদের প্রতি একরাশ ঘৃণা নিয়ে বেড়ে ওঠা সেই বন্ধুটি কালের নিয়মে হারিয়ে গেছে। আজ ও কোথায় আছে, কেমন আছে, জানি না। মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন ড. ফেরদৌস আক্তার।

পুরানো কথা মনে পড়তেই ভাবনারা যেন আরো ডালপালা ছড়িয়ে দিল। নিজের অজান্তেই ডুব দিলাম অতলের অন্ধকারে। সমাজকর্মী তারানা ব্রুক সেই ২০০৬ সালে শুরু করেছিলেন যৌন নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলন # Me too। এর পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই দুনিয়ার কোথাও না কোথাও ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালীদের মুখোশ খসেছে। # যা আস্তে আস্তে হয়ে উঠল নির্যাতিতা নারীর এক অনন্য প্ল্যাটফর্ম। যা-ই হোক, এটা যে নারীর মানসজগতে একটা ধাক্কা দিচ্ছে, সেটা বেশ বুঝতে পারছি। কিন্তু আমাদের এই পোড়া সমাজের নারীরা কতটুকু প্রকাশ করতে পেরেছে সেসব না-বলা কথা? কয়জন নারী বলতে পারবেন বুকে হাত রেখে, জীবনে কোনো দিন কোনো কালো হাত এগিয়ে আসেনি আপনার দিকে? নিন্দার কাঁটায় ব্যবচ্ছেদ হওয়া থেকে আমাদের # Me too বাঁচাবে না জানি। আমরা তাই নির্বাক।

কয়েক দিন ধরে আমার ছোট্ট মেয়েটার দিকে তাকালেই ওয়ারীর সাত বছরের শিশুটির কথা মনে হয়। বিশ্বাস-অবিশ্বাস সব গুলিয়ে যায়। তবে কি এ তিমির লড়াই শুরু হয়ে গেল আমার মেয়েরও! এত তাড়াতাড়ি! আমি টিভি প্রায় দেখি না, পত্রিকায় চোখ বুলালে প্রতিদিনই কোনো না কোনো অঘটন চোখে পড়ে আর অস্থির দিন কাটে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মানবাধিকার প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছরের তুলনায় ধর্ষণের হার এ বছর প্রায় দ্বিগুণ। শিশু অধিকার ফোরাম বলেছে, মাসে গড়ে ৮৩টি শিশু ধর্ষিত হচ্ছে আর গত পাঁচ বছরে ধর্ষণজনিত হত্যার বড় শিকার সাত থেকে ১২ বছর বয়সী মেয়েশিশুরা। আমি সত্যি স্তম্ভিত হই এসব জেনে, বুঝে, শুনে। আমারও যে এ বয়সী একটি মেয়েশিশু আছে।

আমার প্রশ্ন হলো, সমাজে এ পৈশাচিক নির্যাতনের হার এত লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে কেন? তবে কি মিডিয়া একদিকে আমাদের সজাগ করছে, অন্যদিকে নরপশুরাও কান খাড়া করে শুনছে? এই ভেবে তালিয়া বাজাচ্ছে যে পাশবিক প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার একটি নির্ঝঞ্ঝাট জায়গা আছে! পাঁচ বছর তো অনেক দূর, দুই বছরের ডায়াপার মোড়া শিশুটিও হতে পারে তাদের শিকার!

‘উপর্যুপরি গণধর্ষণ’, ‘পালাক্রমে ধর্ষণ’—এজাতীয় শব্দমালা যে মানবরূপী দানবদের লাম্পট্যকে আরো বেশি উসকে দিতে পারে, সেটা কি ভেবে দেখেছি আমরা? কাটতি বাড়ানিয়া এই ভয়ংকর শব্দগুলোর ব্যবহারে মিডিয়াকে সতর্ক হওয়া উচিত বলে মনে করি।

আরেকটি বিষয়ও আমাকে ভাবায় প্রচুর। একটি মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলে প্রায়ই আমরা মিডিয়ায় দেখি, তার ইজ্জতহানি কিংবা সম্ভ্রমহানি হয়েছে বলে লেখালেখি হয়। বাংলা একাডেমি অভিধানে ‘Rape’-এর বাংলা অর্থ ধর্ষণ বা বলাৎকার, ‘ইজ্জত নষ্ট করা’ নয়। আদৌ কি ধর্ষণের সঙ্গে ইজ্জত বা সম্ভ্রমহানির কোনো সম্পর্ক আছে? কারো বলপূর্বক আক্রমণে একটি ছেলের অঙ্গহানি হলেও তার সম্মানহানি হয় না। মেয়েদের ওপর বয়ে যাওয়া এই পাশবিকতা, গুরুতর জখম কেন তার সম্মানে আঘাত হানবে?

এবার মূলকথায় আসি। নুসরাত ফেনীর না তেঁতুলিয়ার, তা আমরা অনেকেই জানি না; কিন্তু নুসরাত এখন গোটা দেশের লাঞ্ছিত আপসহীন নারীর ব্র্যান্ড নেম। এক অনন্ত অগ্নিবর্ণা। ওর জন্য মানববন্ধনে এ দেশের মাটি কিছুটা হলেও কেঁপেছে, আহা-উহু করেছি আমরা অনেকেই—এটি সত্যি প্রশংসনীয়। অনেক প্রতিষ্ঠানে প্রবর্তন করা হয়েছে সাহসী কন্যার জন্য ‘নুসরাত পদক’। আহা, এর আধা আবেগ কি উদিগরণ হতে পারে না, যারা বেঁচে আছে তাদের জন্য? শরীয়তপুরে মেয়রপুত্র দ্বারা লাঞ্ছিত কলেজছাত্রীর জন্য একটু প্রতিবাদ করা যায় না বুক চিতিয়ে? সপ্তাহ না ঘুরতেই জামিনে ঘুরে বেড়াচ্ছে অপরাধী। আতঙ্কিত মেয়েটির দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে ভয়। আহা, কিশোরী, মৃত্যুকে তুমি কেন করলে জয়?

ধর্ষকের তালিকাটি নিয়েও আমি হতবাক। বখাটে থেকে মেয়র-মন্ত্রীপুত্র, জাতির বিবেক বা মেরুদণ্ড গড়ার কারিগরও রয়েছে এ সারিতে। দুঃখের সঙ্গে বলছি, পরিজনদের ফর্দ প্রণয়নে আমার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। তাহলে উপায়? সুরক্ষার বড় জায়গাও তাই পরিবার। বদলাতে হবে বীজ বা মূল থেকে আরেকটি সুস্থ সমাজ অঙ্কুরোদ্গমের জন্য। ধর্ষণ বা খুন হঠাৎ করে হওয়া কোনো বিস্ফোরণ নয়। ছোটবেলা থেকে ঘটে যাওয়া একটি ‘চেইন অব রি-অ্যাকশনের’ শেষ প্রডাক্ট একজন খুনি বা ধর্ষক। গবেষণা বলছে, ছোটবেলা থেকেই নারীদের সম্মান না করার সংস্কৃতি, টিটকারি-কৌতুক, তাদের শক্তি বা ক্ষমতাকে হেয় করা, পারিবারিক বৈষম্য, খারাপ সাইটগুলোর সহজপ্রাপ্যতা, বিচারহীনতা—এ রকম আরো অনেক কারণ একটু একটু করে নষ্ট করে একটি আত্মাকে, একটি সমাজকে। পরিবার তো বটেই, একজন মা, একজন নারীর ভূমিকা এখানে সর্বাগ্রে।

আমার এক বোন তার বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া মেয়েকে সুন্দর পোশাক পরে চুল খোলা রেখে বাইরে যেতে দেয়নি কখনো, যাতে ছেলেদের দৃষ্টি এড়াতে পারে। এরপর হিজাব পরেও সে ইভ টিজিং এড়াতে পারল না। সব শেষে হয়তো বোরকা রক্ষাকবচ লাগবে। এতেও যে শেষ রক্ষা হবে, তেমন আশার জোর খুব একটা নেই। কারণ তনু-নুসরাতরা তো পর্দার অন্তরালেই ছিল, তবু কেন বাঁচতে পারল না। নারায়ণগঞ্জের মাদরাসার অধ্যক্ষ যে ১২টি শিশুকে নিগ্রহ করেছে, তারা তো প্রলুব্ধকারী ছিল না, সবাই ১০ বছরের কম বয়সী।

স্বামীরা, বাবারা, আপনারা যতই ভালো মানুষ হোন না কেন, দয়া করে বিশ্বাস করুন যে সবাই ভালো নয়, একটা মেয়ে সহ্যের সীমা অতিক্রান্ত না হলে এমনি এমনি এত স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কিছু বলে না। তাকে সাহস দিন, প্রতিবাদ করুন। রামচন্দ্ররা শুনুন, অগ্নিপরীক্ষার নামে সীতা বিসর্জন দিতে দিতে আপনার শিশুটির বলি হওয়ার সময় এসেছে। এগিয়ে আসুন, তাকে রক্ষা করুন।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, অ্যাগ্রোনমি অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি - dainik shiksha মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! - dainik shiksha খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ - dainik shiksha এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে - dainik shiksha মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা - dainik shiksha মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! - dainik shiksha মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036900043487549