ফেনীর সোনাগাজীতে মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন হয়রানির মামলায় অভিযোগপত্র (চার্জশিট) জমা দিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
তদন্তকারী কর্মকর্তা শাহ আলম বুধবার বিকালে ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জাকির হোসেনের আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। অভিযোগপত্রে সোনাগাজী ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলাকে একমাত্র আসামি করা হয়েছে।
ঘটনার দুই মাস পাঁচ দিনের মাথায় মামলাটির চার্জশিট দেয়া হল। আজ চার্জশিটের ওপর আদালতে শুনানি হবে বলে জানিয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা শাহ আলম। তিনি বলেন, ‘অধ্যক্ষ সিরাজ রাফিকে যৌন হয়রানির কথা স্বীকার করেছে।
হত্যা মামলায় সে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। সেই জবানবন্দিতে ২৭ মার্চ যৌন হয়রানির বিষয়টি স্বীকার করেছে। তাই এই মামলায় নতুন করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার প্রয়োজন হয়নি।’
আদালত সূত্র জানায়, ২৭ মার্চ সকালে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলা ওই মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে তার কক্ষে ডেকে নিয়ে যৌন হয়রানির চেষ্টা করেন। এ ঘটনায় নুসরাতের মা সোনাগাজী থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা করেন।
পুলিশ ওই দিনই মাদ্রাসার অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠায়। ৬ এপ্রিল সকালে রাফি পরীক্ষা দিতে গেলে বোরকা পরিহিত কয়েকজন তাকে ডেকে মাদ্রাসার প্রশাসনিক ভবনের ছাদে নিয়ে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে বলে।
রাজি না হলে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় তারা। ১০ এপ্রিল রাত ১০টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় রাফি।
এ ঘটনায় রাফির বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন। রাফির মায়ের করা শ্লীলতাহানির মামলার চার্জশিট বুধবার দেয়া হল। এর আগে রাফির ভাইয়ের করা হত্যা মামলার চার্জশিট দেয় পিবিআই।
অধ্যক্ষের কক্ষ থেকে রাফিকে কাঁদতে কাঁদতে বের হতে দেখি- মাদ্রাসার পিয়নের সাক্ষ্য : এদিকে রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা মামলায় মঙ্গল ও বুধবার বিকালে বিচারিক আদালতে আংশিক সাক্ষ্য দিয়েছেন চার নম্বর সাক্ষী মাদ্রাসার পিয়ন (অফিস সহকারী) নুরুল আমিন।
ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদের আদালতে সাক্ষ্য দেন তিনি। আদালত বুধবার বিকাল ৫টা পর্যন্ত তার সাক্ষ্য নিয়ে শুনানি মুলতবি করেন।
এর আগে বেলা ১১টায় তার অবশিষ্ট সাক্ষ্য ও জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী। বিচারিক আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) হাফেজ আহাম্মদ এসব তথ্য জানিয়েছেন।
বাদীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট শাহজাহান সাজু বলেন, নুরুল আমিন সাক্ষ্য দেয়ার সময় আদালতকে বলেন, ‘অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলার নির্দেশে ২৭ মার্চ সকালে রাফিকে ক্লাস থেকে তার (অধ্যক্ষ) কক্ষে যেতে বলেছিলাম। রাফি সে সময় ক্লাসে বসে সহপাঠীদের সঙ্গে গল্প করছিল। রাফি তার বান্ধবী নিশাত সুলতানা ও নাসরিন সুলতানা ফুর্তিকে নিয়ে অধ্যক্ষের কক্ষে যায়। অধ্যক্ষ সিরাজ নিশাত ও ফুর্তিকে কক্ষের বাইরে বের করে দেন। এর কয়েক মিনিট পর অধ্যক্ষের কক্ষ থেকে রাফিকে কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে বাড়ি চলে যেতে দেখি। পরে রাফিকে সঙ্গে নিয়ে তার মা, ভাই রাশেদুল হাসান রায়হান ও স্থানীয় কাউন্সিলর ইয়াসিন অধ্যক্ষের কক্ষে যান। এ সময় অধ্যক্ষ সিরাজ উল্টো তাদের গালমন্দ করেন। তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে অধ্যক্ষ ফোন করলে পুলিশ মাদ্রাসায় যায়।’
এর আগে একই আদালতে বেলা ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত সাক্ষী নাসরিন সুলতানা ফুর্তিকে জেরা করেন আসামি পক্ষের আইনজীবীরা।
উল্লেখ্য, ২৯ মে ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসাইনের আদালতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহ আলম ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে হত্যা মামলার চার্জশিট দাখিল করেন।
৩০ মে মামলার ধার্য তারিখে আসামিদের আদালতে হাজির করা হলে আদালত শুনানি না করে মামলাটি ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতে পাঠানোর আদেশ দিয়ে ১০ জুন মামলার শুনানির দিন ধার্য করেন। ১০ জুন আদালত চার্জশিট আমলে নিয়ে ২০ মে চার্জ গঠনের দিন ধার্য করেন।
আদালত সূত্র জানায়, ২৭ ও ৩০ জুন নুসরাত হত্যা মামলার বাদী ও রাফির ভাই মাহমুদুল হাসান নোমানকে জেরার মধ্য দিয়ে বহুল আলোচিত এ মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। ১ জুলাই নুসরাতের সহপাঠী নিশাত সুলতানার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়।