রক্তাক্ত মার্চ ও বাঙালি মানস - দৈনিকশিক্ষা

রক্তাক্ত মার্চ ও বাঙালি মানস

মুজম্মিল আলী |

মার্চ বাঙালির অস্তিত্বের সাথে মিশে যাওয়া আনন্দ-বেদনার মাস। এ মাসে প্রাপ্তির যেমন আনন্দ আছে, তেমন হারাবার বেদনাও প্রচুর। বাঙালি মানসে মাসটির  আলাদা গুরুত্ব। এ মাসেই আমরা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করি। ২৬ মার্চ, আমাদের জাতীয় জীবনের এক সোনালি দিন। সোনালি অধ্যায়। সেদিনই বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে নিজের অস্তিত্বের জানান দেয় আমাদের স্বাধীন স্বদেশ। প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ। আমরা অর্জন করি স্বাধীন ও সার্বভৌম এক গর্বিত জাতির মর্যাদা। সেদিনই আমাদের একান্ত উপলব্ধিতে আসে 'স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায় ?'

২৫ মার্চের কালরাত বাঙালির ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ্যায়। সে কালরাতের কথা স্মরণ করে আজও আমরা আঁতকে উঠি। কী ভয়ঙ্কর সে রাত ছিল! 'অপারেশন সার্চলাইট' নাম দিয়ে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার এক উন্মাদ নেশায় সে রাতে মেতে ওঠে পাকিস্তানি হায়েনার দল। জল্লাদ ইয়াহিয়ার আস্ফালন বাঙালি কোনোদিন ভুলতে পারে না।
  
নিরীহ, নিরপরাধ ও ঘুমন্ত মানুষের ওপর দুনিয়ার কোথাও কেউ এভাবে জানোয়ারের মতো খুনের নেশায় মেতে উঠেছিল কিনা জানা নেই। মানুষ পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট হতে পারে- পশ্চিম পাকিস্তানিরা সে রাতেই প্রমাণ দিয়েছিল। সে ভয়াবহ রাতের চার যুগ পেরিয়ে আজও রাতটির বিভীষিকাময় স্মৃতির কথা মনে করে অনেকে শিউরে ওঠে। যারা কেবল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়েছে তারা পর্যন্ত আঁতকে ওঠে। বাঙালি জাতির ওপর দিয়ে সে রাতে কী ভয়ানক দুর্যোগ অতিবাহিত হয়েছে তা কল্পনা করাও কঠিন। কী ভয়াল রাত ছিল সেটি! এক কালজয়ী আহ্বান- 'যার যা আছে, তা নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা কর' বাঙালি জাতিকে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মন্ত্রে উজ্জ্বীবিত করেছিল। তারা ভেঙ্গে পড়েনি। তারা জানতো শেখ মুজিব নামে তাদের একজন নেতা আছেন। ততদিনে শেখ মুজিবের প্রতি বাঙালির অন্য এক আস্থা-বিশ্বাস জন্মেছিল। তারা বুঝতে সক্ষম হয়েছিল যে, একজন মুজিব তাদের ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তার হাত ধরে স্বাধীনতার লাল সূর্য উদিত হবেই। মুজিব তাদের সে বিশ্বাসের ষোল আনা মর্যাদা দিতে পেরেছিলেন।
 
বাঙালির সে মহানায়কের জন্ম হয়েছিল এই মার্চ মাসেই। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে মা-বাবার কোল আলোকিত করে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মার্চ মুজিবের আগমন। কে জানত শেখ বাড়ির সেদিনের ছোট্ট শিশুটি একদিন বাঙালি জাতির জনক শেখ মুজিব হবেন। বাবা শেখ লুৎফর রহমান আর মা সায়েরা খাতুনও জানতেন না তাদের শিশু সন্তানটি একদিন বাঙালি জাতির কাণ্ডারি হবেন। বাঙালির মহানায়ক হবে। কে জানত মুজিবের ডাকে সাড়া দিয়ে গোটা জাতি এক রক্তাক্ত সংগ্রামে জড়িয়ে পড়বে। রক্তের এক বিশাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনবে। কেউ জানত না মুজিব নামে ছেলেটি একদিন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির মর্যাদায় ভূষিত হবে। উপমহাদেশে গণতন্ত্রের মানসপুত্র খ্যাত হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাকে ঠিকই ধরতে পেরেছিলেন। তাকে ঠিকই চিনতে পেরেছিলেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হক। তার মাঝে আগামীর বাংলাদেশকে খুঁজে পেয়েছিলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। কথায় বলে 'মানিকে মানিক চেনে রতনে রতন '। মুজিব তাই তাদের স্নেহ ভালোবাসায় দিনে দিনে রাজনীতির ময়দানে এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হয়ে ওঠেন।


                                     
এই মার্চেই বঙ্গবন্ধু ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতার জাদু মন্ত্রে গোটা জাতিকে পাগল করার বাঁশিটি বাজিয়েছিলেন। এমন বাঁশির সুর জাতিকে ঘরে থাকতে দেয়নি। হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো  সুর ধরেন, 'এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম '। এই সুর দল মত নির্বিশেষে সব বাঙালিকে বিনি সুতার মালায় আবদ্ধ করে ফেলে। এক জায়গায় এনে সকলকে জড়ো করে দেয়। স্বাধীনতার জাদুমন্ত্রে বাঙালি পাগলপারা হয়ে যায়।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্ত মঞ্চে মুজিব তার জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণটি দেন। সেটি কোনো লিখিত ভাষণ ছিল না। ভাষণের ধারাবাহিকতায় পূর্ব প্রস্তুতির কোনো আভাস মেলে না। প্রায় দশ লক্ষ মানুষ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পিন পতন নীরবতায় বঙ্গবন্ধুর রক্ত গরম করা ভাষণটি শুনেছিল। এই একটি ভাষণই বাংলাদেশ ও বাঙ্গালির স্বাধীনতার জন্য যথেষ্ট হয়ে উঠেছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম আরেকটি ভাষণ খুঁজে পাওয়া কঠিন। সেই থেকে ৭ মার্চ বাঙালির ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক দিন।                             
আজ ২৬ মার্চ। বাঙালির ইতিহাসে সবচে' গৌরবময় দিন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের এদিন বাঙালি বিশ্ব দরবারে মর্যাদার আসন লাভ করে। আত্মত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হয়ে মাতৃভূমির মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। পৃথিবীর মানুষ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে বাংলাদেশের অবাক করা কাণ্ড। একেবারে নিরস্ত্র হয়ে সশস্ত্র শত্রুর মোকাবেলায় যে পারঙ্গমতা বাঙালি সেদিন প্রদর্শন করেছে, তা' পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। মার্চের শেষ থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত মাত্র ৯ মাস সময়ে দেশকে পুরোপুরি শত্রুমুক্ত করার ইতিহাস কেবল বাঙালিরই আছে। আর কারো নেই।

প্রতি বছর তাই মার্চ এলেই তারা অন্য এক ব্যঞ্জনায় মেতে ওঠে। আনন্দ, উচ্ছ্বাস ও বেদনায় সকল মুক্তিযোদ্ধাকে স্মরণ করে। যারা বেঁচে আছেন আর যারা বেঁচে নেই, তাদের সবাইকে শ্রদ্ধা ও সম্প্রীতি দিয়ে সিক্ত করে। তাদের জন্য ভালোবাসা ও গৌরবের গান গেয়ে বেড়ায়। মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা আত্ম বিসর্জন দিয়েছেন, তাদের সবার পবিত্র স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আজকের লেখা এখানেই শেষ করতে চাই। যারা শহিদ হয়েছেন এবং যারা বুদ্ধ করেছেন তারা বেঁচে থাকুক আদি ও অনন্তকাল শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে। বাঙালি মানসে তাদের আসন জাগ্রত থাকুক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রতিনিয়ত বেড়ে উঠুক আমাদের নতুন প্রজন্ম।   

লেখক : অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ কানাইঘাট, সিলেট।   

 

নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0048079490661621