আজ পহেলা মার্চ। ঐতিহাসিক মার্চের প্রথম দিন। রক্তের পথ যাত্রার প্রথম প্রহর। স্বাধীনতার সূর্যোদয়ের মাহেন্দ্র ক্ষণ। বাঙালির আবেগ ও উচ্ছ্বাসের মাস। অন্য যে কোনে মাস থেকে আলাদা এর আবেদন। জাতি অস্তিত্বের ঠিকানা খুঁজে ফেরে প্রতি ক্ষণে, প্রতি মুহূর্তে। হৃদয় মানসে মাসটি চির জাগ্রত একটি নাম। একটি প্রত্যয় ও প্রত্যাশার বাতিঘর। রক্ত দেয়া আর রক্ত ঝরানোর একেকটি দিন মার্চকে মহিমান্বিত করেছে। মার্চ আসে চাওয়া পাওয়া আর হারানোর আনন্দ ও বেদনার উচ্ছ্বাস হয়ে। স্মৃতিময় মার্চ কোনোদিন বিস্মৃতির পথে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা নেই। পথ হারা জাতিকে যুগ-যুগান্তরে অন্ধকারে পথ দেখিয়ে দেয়ার এ এক বিশাল মশাল। এর আলোয় হাজার বছরের সুদীর্ঘ পথটি আলোকিত সরল রেখায় মিলিত হয়। ত্বড়িৎ জাগ্রত হবার মানসে নড়ে চড়ে উঠে মৃত্যু পথচারী মানুষ। দিশেহারা মানুষ খুঁজে পায় সঠিক নির্দেশনা। হাজার বছরের অন্ধকার ভেঙে চুরমার হয়ে পূর্বাকাশে জ্বলে উঠে প্রত্যাশার সূর্যোদয়।
আদি ও অনন্তকাল থেকে মার্চ আর বাঙালি মানসের আপোস হয়ে পথ চলা। ঋতুরাজ বসন্তের সাথে এর সখ্যতা। একান্ত হৃদ্যতায় মার্চ আর বসন্ত পরস্পরের স্বজন। বসন্তে মার্চ আসে। মার্চে বসন্তের দেখা মেলে। বসন্ত পলাশে পলাশে সাজিয়ে দেয় প্রতিটি দিন। প্রতিটি মুহূর্ত। একে অন্যেকে গাছে গাছে ডালে ডালে মুকুল সাজিয়ে স্বাগত জানায়। এক পথ দিয়ে বসন্ত আর মার্চের আনাগোনা। আদিকাল থেকে মার্চ আর বসন্ত একে অন্যের। তাদের মাঝে হৃদ্যিক ভালোবাসার এক অকৃত্রিম বন্ধন। সে বন্ধনটি ছিঁড়ে যাবার নয়। ছিন্ন হবারও নয়। কেবল মার্চ নয়। মহান একুশে ফেব্রুয়ারিও বসন্তের মায়াজালে আবদ্ধ আরেক সোনালী দিন, আরেক সোনালী অর্জন। এই সূত্রে বসন্ত, ফেব্রুয়ারি আর মার্চ -বাঙালির সোনালী ক্যালেন্ডারের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
শুধু কী তাই? মার্চেই বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান শেখ মুজিবের ধরাধামে আগমন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মার্চ জন্ম নেয়া টুঙ্গিপাড়ার শেখ বাড়ির শিশু মুজিব আজ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। বাঙালির অবিসংবাদিত মহানায়ক। আগত অনাগত সর্বকালের আশার বাতিঘর। চেতনার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। শেখ মুজিবের নামে দুর্দিনে দুঃসময়ে জেগে উঠে বাঙালি হৃদয়। তাঁর নামে অসুরের সাথে লড়ে যায় মানুষ। অপশক্তি নিপাত যায়। জয় হয় মানবতার। মানুষ গেয়ে উঠে মানুষের গান।
মার্চ মাস অজপাড়াগাঁয়ের মুজিবকে জাতির পিতা মুজিব বানিয়েছে। বাঙালির মহানায়কের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। ৭ মার্চের অনবদ্য ভাষণটি শেখ মুজিবকে আব্রাহাম লিংকন, মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষ প্রমুখের আসনে অভিষিক্ত করেছে। বাঙালির প্রাচীর ভেদ করে বিশ্ব সীমানায় নিয়ে গেছে। শেখ মুজিব আজ শুধু ‘বঙ্গবন্ধু’তে আবদ্ধ নন, তিনি এখন ‘বিশ্ববন্ধু’ও বটে। শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণটি অপরাপর বিশ্ব নেতাদের ভাষণ থেকে স্বতন্ত্র একারণে যে, এটি কোনো লিখিত ভাষণ ছিল না। এটির কোনো পূর্ব পরিকল্পনাও ছিল না। হৃদয়ের আবেগ, উচ্ছ্বাস আর ভালোবাসায় সেদিন রেসকোর্সে মুজিব যে ভাষণটি দিয়েছিলেন, সে রকম একটি ভাষণ আর কোনোদিন কেউ দিতে পারবেন বলে আমার অন্তত মনে হয় না।
কেবল তাই নয়। মার্চ মাসটি বাঙালির স্বাধীনতার সূর্যোদয়ের মাস। ’৭১-র রক্তাক্ত মার্চে নির্ভিক হাতে জাতি স্বাধীনতার লাল সবুজের পতাকাটি উড়াতে পেড়েছিল। সেই থেকে বাংলাদেশটি কেবলি তাদের। আমরা এক গর্বিত লাল সবুজের পতাকার মালিক। এবারের মার্চটি অন্য আরেক কারণে বিশেষ তাৎপর্যময়। এবার মুজিববর্ষ উদযাপনের বছর। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর বছর। বছরটিকে ঘিরে হাজারো প্রত্যাশায় ঘুরপাক খাচ্ছে মানুষ। সারাবছর ধরে মানুষের প্রত্যাশা পূরণে সরকারের করণীয় কী হবে-সেদিকে সবাই চেয়ে আছে।
এবারের মার্চ মাসটিকে মুজিববর্ষের সূর্যোদয়ের মাস বলে গণ্য করাই সমীচীন। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, স্বাধীনতা দিবস আর বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী মিলে এবারের মার্চ মাসটি স্বকীয়তা নিয়ে বেঁচে থাকুক। মুজিববর্ষের সূর্যোদয়ের মাসে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণের অঙ্গীকার নিয়ে আমরা এগিয়ে যাই-এই হোক আমাদের প্রত্যয়। সরকার একান্তই জনগণের হোক। স্বাধীনতার মাসে স্বাধীনতার মহানায়ক শেখ মুজিব ও সকল শহীদদের জন্য হৃদয়ের অপার শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করি।
লেখক : অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।