ইউকিপিডিয়ার তথ্যমতে, সাহিত্য বলতে যথাসম্ভব কোন লিখিত বিষয়বস্তুকে বোঝায়। সাহিত্য শিল্পের একটি অংশ বলে বিবেচিত হয়। সাহিত্য এমন কোন লেখনী যেখানে শিল্পের বা বুদ্ধিমত্তার আঁচ পাওয়া যায়। অথবা বিশেষ কোন প্রকারে সাধারণ লেখনি থেকে আলাদা।
মোটকথা ইন্দ্রিয় দ্বারা জাগতিক বা মহাজাগতিক চিন্তাচেতনা, অনুভূতি, সৌন্দর্য ও শিল্পের লিখিত বা লেখকের বাস্তব জীবনের অনুভূতি হচ্ছে সাহিত্য।
এ থেকেই বোঝা যায় সাহিত্য কোন সাধারণ বিষয় নয়। মানব ও সমাজ জীবনের দর্পন বা প্রতিচ্ছবিই সাহিত্যের গুণগত সংজ্ঞা। যখন ভাষার সৌন্দর্য ও আবেগের ক্রিয়াশীলতা শব্দের আশ্রয়ে রূপ লাভ করে, সাহিত্যের জন্ম তখনই।
সাহিত্যের স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, "অন্তরের জিনিসকে বাহিরের, ভাবের জিনিসকে ভাষায়, নিজের জিনিসকে বিশ্বমানবের ও ক্ষণকালের জিনিসকে চিরকালের করিয়া তোলাই সাহিত্যের কাজ।"
আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে সাহিত্য চর্চার অভ্যেস অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। আমরা সাহিত্য সৃষ্টিতেও খুব একটা আগ্রহী নই। আবার সাহিত্য পঠনেও আগ্রহী নই। আমরা আমাদের সম্পর্কেই ভালোভাবে জানার প্রয়োজনবোধ করি না। সেখানে সাহিত্য দূরের কথা।
সমাজে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের বসবাস। বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর সমাজে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন কাজে কর্মে অসুস্থ প্রতিযোগিতার রূপ ফুটে ওঠে।
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের অধিকারীগণ সমাজের মূল সংস্কারক হিসেবে মূখ্য ভূমিকায় থাকার কথা। মানুষের মৌলিক ও সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য যারা কাজ করেন তারাই তো রাজনীতিবিদ। কিন্তু মানুষের জন্য কাজ করতে হলে মানুষ্যত্বের দর্শন জ্ঞান থাকা অবশ্যকরণীয়।
নৈতিক মূল্যবোধ, বিশুদ্ধ বিবেক ও মানবতার সর্বাপেক্ষা প্রয়োগ এবং ব্যবহারই পারে একজন মানবপ্রেমী মানুষ তৈরি করতে। একজন রাজনীতিবিদ হবেন তেমনই একজন মানুষ, যার মধ্যে এই গুণসত্তার স্বচ্ছ অস্তিত্ব থাকবে। এখন প্রশ্ন আসতে পারে এই অস্ত্বিত্ব একজন রাজনীতিবিদের মধ্যে কিভাবে আসবে!? কারণ আমরা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্যে এমন গুণসাগর দেখে অভ্যস্ত নই। এই গুণসত্তার অধিকারী হতে হলে রাজনীবিদদের অবশ্যই সাহিত্য চর্চা করতে হবে। সাহিত্য যদি সমাজ জীবনের দর্পণ হয় তাহলে রাজনীতি হবে রাষ্ট্রের দর্পণ।
বাংলাদেশ রাজনৈতিক ইতিহাস ও ঐতিহ্যের উৎপাদনশীল মাঠ। এই ভুখন্ডেই মহান কিছু রাজনীতিবিদদের জন্ম হয়েছে। তারা আজও আমাদের মাঝে স্মরণীয় হয়ে আছেন ও থাকবেন। তাদের জীবন দর্শন সম্পর্কে অর্জিত জ্ঞান থেকে জানা যায়, মহান এই রাজনৈতিক নেতারা সাহিত্য চর্চা করতেন। তারা শুধু পড়তেন না লিখতেনও। অর্থাৎ তারা শুধু রাজনীতিবিদই ছিলেন না, ছিলেন সাহিত্যিকও।
এজন্যই তারা ছিলেন সৃজনশীল ও গঠনমূলক কাজের উদ্যোক্তা। মানুষের জন্য কাজ করেছেন। মানবতার জন্যই নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন তারা। নৈতিক মূল্যবোধের কারনেই ইতিহাসের পাতায় আজও জ্বলজ্বল করছে তাদের নাম।
প্রতিবছরে আমার শিক্ষার্থীদের প্রথম ক্লাসে জানতে চাই তাদের জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে। অনেকেই জানায় ডাক্তার হবে, ইঞ্জিনিয়ার হবে, কেউ পুলিশ হবে, কেউ বিচারক হবে, কেউ বিসিএস ক্যাডার হবে, কেউ বা শিক্ষক হবে৷ প্রিয় পাঠক, একটি বিষয় নিশ্চয়ই আপনারা লক্ষ্য করেছেন। কোন শিক্ষার্থীই ভবিষ্যতে একজন রাজনীতিবিদ হওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেনি।
আমি আমার শিক্ষকতা জীবনে এমন একজন শিক্ষার্থীকেও পাইনি যে কিনা বলেছে, ভবিষ্যতে একজন রাজনীতিবিদ হতে চাই। কিন্তু কেন এমন অনিচ্ছা পোষণ। এদেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা যদি ভবিষ্যতে রাজনীতির হাল না ধরতে পারে তাহলে দেশ কাদের হাতে চলবে?! আমি আরও অবাক হয়ে যায়, যখন দেখি অভিভাবকদের মাঝে তাদের সন্তানদের একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে কল্পনাতেই আনতে পারেন না। বাস্তব তো দুরের কথা।
এক্ষেত্রে ধারণা করা যেতে পারে রাজনীতির প্রতি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া আছে। আমরা যদি তরুণ প্রজন্মের মাঝে নেতৃত্বের সদিচ্ছা তৈরি করতে না পারি তাহলে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের হাল ধরবে কারা!?
অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের এমন অনিচ্ছা এখনও ইচ্ছায় পরিণত হতে পারে। রাজনীবিদরা যদি মানবাতাবাদী চেতনা নিয়ে কাজ করেন। আর এ চেতনায় উদ্ধুদ্ধ করতে পারে সাহিত্য। বলা মুশকিল বর্তমানে কতজন রাজনীতিবিদ সাহিত্য চর্চা করেন! তাদের দায়িত্ববোধ, দায়বদ্ধতার ধরণ ও বক্তৃতা -বিবৃতি লক্ষ করলে যে চিত্র ফুটে ওঠে, বলাবাহুল্য তা আশাব্যঞ্জক নয়।
এজন্যই রাজনীতির সুস্থ চর্চায় সাহিত্য চর্চার বিকল্প নেই। শিক্ষার্থীদের রাজনীতিতে টেনে আনা নয়, বরং যেদিন শিক্ষার্থীরা নিজে মুখে বলবে তারা ভবিষ্যতে রাজনীতিবিদ হতে চাই, সেদিনই বোঝা যাবে রাজনীতিতে সাহিত্যের প্রভাব পড়েছে। যেদিন অভিভাবকগণ তাদের সন্তানদের ভবিষ্যতে একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ হিসেবে স্বপ্ন দেখবেন সেদিনই বোঝা যাবে, রাজনীতিবিদদের কাজ অনুকরণীয় হতে চলেছে। প্রশংসনীয় হতে চলেছে।
রাজনীতির গুণগত মান ফিরিয়ে আনতে, আদর্শবান ও অনুকরণীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ফিরিয়ে আনতে সাহিত্য চর্চার বিকল্প নেই। রাজনীতিতে সাহিত্যের দর্শনই কেবল সুস্থ রাজনীতির প্রভাবক হিসেবে কাজ করতে পারে।
লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান শামীম, শিক্ষক ও কলামিস্ট।