মোবাইলে গেম খেলতে খেলতে রাতে ঘুমানোর অভ্যাস রাফাতের। এর পাশাপাশি চলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্ধুদের সঙ্গে কথোপকথন। পড়তে বসলেও কেউ কোনো বার্তা পাঠাল কি না তা দেখার জন্য হাতের কাছেই থাকে মোবাইল। গভীরভাবে মোবাইল ও ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে থাকার কারণে মেরুদন্ডের হাড়ে তৈরি হয়েছে সমস্যা। রাতভর না ঘুমানো এবং দেরি করে ওঠার কারণে ক্লাস করা হয়ে ওঠে না তার। ক্লাসে অনুপস্থিতির কারণে সেমিস্টার ফাইনালে অংশগ্রহণ করতে পারেনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এ শিক্ষার্থী। মঙ্গলবার (০২ জুলাই) বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন জয়শ্রী ভাদুড়ী।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সূত্রে জানা যায়, গত বছর পর্যন্ত ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৮ কোটি ৬ লাখ। এর মধ্যে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারের (আইএসপি) মাধ্যমে প্রায় ৫৬ লাখ গ্রাহক রয়েছে। মোবাইল ডেটার মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে প্রায় সাড়ে ৭ কোটি মানুষ। আর এসএনএসের মধ্যে ফেসবুকে নিবন্ধিত ব্যক্তির সংখ্যা ২ কোটি ৯০ লাখ। তবে তারা সবাই সক্রিয় নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের বড় অংশই তরুণ।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ তরুণ, যারা সমাজের কর্মক্ষম ও চালিকাশক্তি। বিশ্বের প্রতি পাঁচজনে একজন বা ২০ শতাংশ তরুণ মানসিক রোগে আক্রান্ত। বিষণ্নতা, উদ্বেগ, মাদকাসক্তি, বুলিং, সাইবার ক্রাইম, গ্যাং কালচার, অবাধ্যতা, দেশিয় সংস্কৃতির বিরুদ্ধাচরণ, ইন্টারনেট ও ফেসবুক আসক্তি, সম্পর্কজনিত ও মানিয়ে চলার বিষয়ে মানসিক সমস্যা থেকে এ রোগের সৃষ্টি। তিনি আরও বলেন, ভার্চুয়াল জগতে সবকিছু সহজ মনে হলেও বাস্তব সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা থাকে না। ফলে খুব দ্রুতই তরুণদের মধ্যে হতাশ হওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। হতাশা মানসিক রোগে পরিণত হয়। প্রাপ্তবয়স্ক ১৬ দশমিক ১ শতাংশ আর ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ শিশু-কিশোর মানসিক রোগে আক্রান্ত।
২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে সোশ্যাল মিডিয়া গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইআর সোশ্যাল ও হুটস্যুট প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারী হিসেবে সারা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা এখন দ্বিতীয়। এখানে ২ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষ সক্রিয়ভাবে ফেসবুক ব্যবহার করছে। বিশ্বের প্রায় ৭৫০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছে ৩৭৭ কোটি; আর তাদের মধ্যে ২৭৮ কোটি ব্যবহারকারী কোনো না কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে সক্রিয়।
দুনিয়াজুড়ে তথ্যপ্রযুক্তির এ উত্থান নিয়ে গবেষণা করেছেন ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার অধ্যাপক স্প্যানিশ বংশোদ্ভূত সমাজবিজ্ঞানী ম্যানুয়ের ক্যাসলস। তিনি ২০০০ থেকে ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত গবেষণা করে ইনফরমেশন এজ (তথ্যযুগ) নামে তিন খন্ডের বই লিখেছেন। এর প্রথম খন্ড হলো- ‘দ্য রাইজ অব নেটওয়ার্ক সোসাইটি’, ‘দ্য ইনফরমেশন এজ : ইকোনমি’, ‘সোসাইটি অ্যান্ড কালচার’। সেখানে বলা হয়েছে, নেটওয়ার্কের কারণে আমরা একটা ভার্চুয়াল জগতে বাস করছি। ধীরে ধীরে ইন্টারনেটের মুখোমুখি দাঁড়াচ্ছে ব্যক্তিজীবন। মানুষ সমাজে একা হয়ে যাচ্ছে।’
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী শরীফ মাহতাব বলেন, ‘আমার ছেলের বয়স ১৪ বছর। ও প্রচণ্ড পরিমাণে মোবাইল ও ল্যাপটপের প্রতি আগ্রহী। হঠাৎ দেখা গেল সে তার বন্ধুদের সঙ্গে প্রায়ই মারপিটে জড়িয়ে পরছে। বাসার সবার সঙ্গেও তার আচরণ খুব রুক্ষ। এক সময় রাগ হলেই জিনিসপত্র ভাঙচুর শুরু করলো। এ পরিস্থিতিতে আমরা ওকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাই। ভার্চুয়াল জগতে নিজেকে জড়িয়ে ফেলায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক।’
সামাজিক যোগযোগ মাধ্যম অনেকেরই আসক্তির পর্যায়ে চলে গেছে। তিনজন মানুষ পাশাপাশি বসে নিজেদের মধ্যে কথা না বলে ব্যস্ত থাকে ইন্টারনেটের ঘেরাটোপে। প্রায় একইরকম বিষয় নিয়ে জরিপ চালিয়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ডিজিটাল ক্ল্যারিটি’। ১ হাজার ৩০০ মানুষের ওপর চালানো এ জরিপে ইন্টারনেট এবং সামাজিক মাধ্যমের প্রতি মানুষের আসক্তির বিষয়টি জনসমক্ষে উঠে এসেছে। জরিপের ফলে দেখা যায়, ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সীরা দৈনিক গড়ে ১৫ ঘণ্টা অনলাইনে সময় ব্যয় করেন। যে কারণে মানসিক নানারকম পরিবর্তন ঘটছে তাদের মধ্যে।
এর মধ্যে রয়েছে অযথা সময় নষ্ট করা, সময়জ্ঞান না থাকা, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া, অফলাইনে থাকলে এক ধরনের অস্থিরতার মধ্যে থাকা।