রাবি ভিসির দুর্নীতি: ইউজিসির সুপারিশের দ্রুত বাস্তবায়ন চান শিক্ষকরা - দৈনিকশিক্ষা

রাবি ভিসির দুর্নীতি: ইউজিসির সুপারিশের দ্রুত বাস্তবায়ন চান শিক্ষকরা

রাবি প্রতিনিধি |

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) উপাচার্যের বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তদন্ত কমিটি। সম্প্রতি কমিটির সদস্যরা প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির কার্যালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। এতে দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে বেশ কয়েকটি সুপারিশ করা হয়। উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা শিক্ষকরা দ্রুত এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন। তবে উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান জানিয়েছেন, সংবাদ সম্মেলন করে জাতির সামনে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করবেন তিনি।

ইউজিসির সুপারিশ

ইউজিসি’র প্রতিবেদনে উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান, উপ-উপাচার্য চৌধুরী মো. জাকারিয়াসহ তাদের ওপর নির্ভরশীল সবার আয়ের এবং স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের উৎস গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে খুঁজে বের করার সুপারিশ করা হয়। এছাড়া তদন্ত কাজে অসহযোগিতার জন্য ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক এম এ বারীকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করে তদন্ত কমিটি। অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়ায় ৩৪ জন শিক্ষকের নিয়োগ বাতিলের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে সুপারিশে।

যাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, তাদের সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। একইসঙ্গে ১৯৭৩ সালের অ্যাক্ট অনুযায়ী শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালা আবার পরিবর্তন করার সুপারিশ করা হয়েছে।

ইউজিসি সদস্য ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, ‘গত মঙ্গলবার প্রতিবেদন তিন জায়গায় জমা দিয়েছি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। শুনানি করে অভিযোগের বিপরিতে যেসব তথ্য পেয়েছি তা উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।’

অভিযোগ

চলতি বছরের শুরুর দিকে রাবি ভিসিসহ বর্তমান প্রশাসনের অনিয়ম ও দুর্নীতির ৩০০ পৃষ্ঠার একটি অভিযোগপত্র প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসিতে জমা দেন আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের একাংশ। এতে ৬২ জন শিক্ষক সই করেন। বেশ কয়েকটি অভিযোগ আনা হয় এতে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তদন্তে নামে ইউজিসি।

অভিযোগের মধ্যে ছিল- শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালার পরিবর্তন করে উপাচার্যের নিজ কন্যা ও জামাতাকে নিয়োগ, উপাচার্যের অবসরগ্রহণের পর পুনরায় দায়িত্ব পালন এবং রাষ্ট্রপতিকে অসত্য তথ্য প্রদান, উপাচার্যের বাড়ি ভাড়া নিয়ে দুর্নীতি, অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়াকে উপ-উপাচার্য নিয়োগ ও তার নিয়োগ বাণিজ্য, বিভিন্ন নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতিসহ অন্যান্য। বেশ কয়েকটি অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি।

মেয়ে ও জামাতাকে নিয়োগ দিতে আবেদন যোগ্যতা শিথিল

অভিযোগপত্র সূত্রে জানা যায়, অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্য  হওয়ার পর ৪৭৫তম সিন্ডিকেটে শিক্ষক নিয়োগ-নীতিমালা পরিবর্তন করে। এতে শিক্ষক নিয়োগের যোগ্যতা কমানো হয়। আগের নীতিমালায় আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা ছিল সনাতন পদ্ধতিতে এসএসসি থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত চারটি স্তরেই প্রথম শ্রেণি। আর গ্রেড পদ্ধতিতে এসএসসি ও এইচএসসিতে ন্যূনতম জিপিএ ৪.৫০, স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তরে ন্যূনতম সিজিপিএ ৩.৫০। একইসঙ্গে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তরে সংশ্লিষ্ট বিভাগের মেধাক্রম প্রথম থেকে সপ্তমের মধ্যে থাকতে হবে। কিন্তু সেই যোগ্যতা কমিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে সিজিপিএ ৩.২৫ এ নামিয়ে আনা হয় এবং মেধাক্রমে থাকার শর্তও তুলে দেওয়া হয়।
রাবি উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নতুন নিয়োগ যোগ্যতায় উপাচার্যের মেয়ে, জামাতাসহ ৪৩ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উপাচার্যের কন্যা, জামাতাসহ অন্তত ৩৪ জন শিক্ষকেরই আগের নীতিমালায় আবেদন করারই যোগ্যতা ছিল না। নিয়োগের যোগ্যতা শিথিলের পর উপাচার্যকন্যা সানজানা সোবহান ও জামাতা এ টি এম শাহেদ পারভেজ শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। এর মধ্যে মার্কেটিং বিভাগ থেকে পাস করা সানজানা নিয়োগ পান ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে। আর শাহেদ নিয়োগ পান ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটে (আইবিএ)। মেয়ের মেধাক্রম ছিল ২১ এবং জামাতার ৬৭তম । আগের নীতিমালা থাকলে তারা শিক্ষক হওয়ার আবেদনই করতে পারতেন না।

এছাড়া আইন বিভাগের নিয়োগ পাওয়া তিন শিক্ষকের মধ্যে দুজনেরই পূর্বে নীতিমালায় আবেদন যোগ্যতা ছিল না। এদের মধ্যে নিয়োগ পাওয়া মো. সালাউদ্দিন সাইমুম পরে উপ-উপাচার্য চৌধুরী মো. জাকারিয়ার মেয়েকে বিয়ে করেন। অভিযোগ আছে ‘যোগসাজশ’ করেই এই নিয়োগ দেওয়া হয়। আরেকজনও বিভাগের এক শিক্ষকের স্ত্রী।

এছাড়া আইন বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্যের একটি ফোনালাপ ফাঁস হয়। যেখানে রাবি উপ-উপাচার্য চৌধুরী মো. জাকারিয়াকে এক চাকরি প্রত্যাশীর স্ত্রীর সঙ্গে দরকষাকষি করতে শোনা যায়।

নিয়োগ নীতিমালা পরিবর্তনের পর ২০১৮ সালে চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান বিভাগে চার জন শিক্ষক নিয়োগ হয়। যাদের মধ্যে তিনজনের আগের নীতিমালা অনুযায়ী আবেদন করার যোগ্যতাই ছিল না। শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে নিয়োগ পাওয়া পাঁচ জনের মধ্যে চার জনেরই আগে নীতিমালায় আবেদন যোগ্যতা ছিল না। ইইই বিভাগের চার  জনের মধ্যে একজনের,  এছাড়া আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ট্যুরিজম, পদার্থবিজ্ঞান , ব্যাংকিং ও ইনস্যুরেন্স বিভাগ, ব্যবহারিক গণিত, বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন যাদের অনেকেরই পূর্বের নীতিমালায় আবেদন যোগ্যতা ছিল না। তদন্ত প্রতিবেদনে ৩৪ শিক্ষকের নিয়োগ বাতিলের পরামর্শ দেওয়া হয়।

উপাচার্যের বাড়ি ভাড়া নিয়ে দুর্নীতি 

উপাচার্য আবদুস সোবহান ২০১৭ সালের মে মাসে দায়িত্ব নিয়ে উপাচার্যের বাসভবনে ওঠেন। এ জন্য ২০১৩ সাল থেকে অধ্যাপক হিসেবে তার নামে বরাদ্দ করা ডুপ্লেক্স বাড়িটি কাগজপত্রে ছেড়ে দিলেও আসবাব রাখার জন্য প্রায় দেড় বছর দখলে রাখেন। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয় বাড়ি ভাড়ার আয় থেকে বঞ্চিত হয়।

রাষ্ট্রপতিকে অসত্য তথ্য প্রদান ও অবসর গ্রহণ

অধ্যাপক এম  আব্দুস সোবহান ২০১৭ সালে ৭ মে দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর একই বছরের ২১ জুন রাষ্ট্রপতিকে না জানিয়ে উপাচার্যের পদে থেকে ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান ও ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। আবার ওই দিনই তিনি বিভাগ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। ফলে উপাচার্যের পদে সাময়িক শূন্যতা সৃষ্টি হয়।

এছাড়া স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে তিনি রাষ্ট্রপতিকেও অসত্য তথ্য দিয়েছেন বলে অভিযোগপত্রে জানান শিক্ষকরা। অভিযোগে বলা হয়, উপাচার্যের অনুপস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক আখতার ফারুককে নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব পালনের জন্য অনুমতি প্রার্থনা করে ২৪ জুন রাষ্ট্রপতি ও আচার্যের অনুমতির জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠান। চিঠিতে তিনি ২৯ জুন অবসরে যাওয়ার অনুমতি আবেদন করেন।

অভিযোগকারী শিক্ষকরা অভিযোগ পত্রে  দাবি করেন, উপাচার্য পদে সাময়িক শূন্যতা পূরণে ‘রাষ্ট্রপতির অনুমতি ছাড়াই’ এক দিনের জন্য বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. আখতার ফারুককে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য নিয়োগ দেন। যা ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের পরিপন্থী।

প্রতিক্রিয়া

অভিযোগকারী শিক্ষকদের একজন ম্যানেজন্টে বিভাগের অধ্যাপক সোলাইমান চৌধুরী। ইউজিসির ডাকা শুনানিতে অংশ নিয়েছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন জমা হওয়ায় সত্যি ভালো লাগছে। তবে আরও ভালো লাগবে তদন্ত প্রতিবেদনে যে সব সুপারিশ করা হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব হলে। এই রিপোর্টটি বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি যুগান্তকারী রিপোর্ট হিসেবে বিবেচিত হবে। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে মাননীয় উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যরা বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি থেকে বিরত থাকবেন বলে মনে করি।’

ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার বিষয়টি জেনেছেন উল্লেখ করে ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের সভাপতি ও অভিযোগকারী শিক্ষকদের মুখপাত্র অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম টিপু বলেন, ‘আমরা চাই তদন্ত কমিটির সুপারিশ দ্রুত সময়ে কার্যকর করে শিক্ষাঙ্গনকে কলুষমুক্ত করা হোক। বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠবে শিক্ষা, গবেষণা ও সাংস্কৃতিক চর্চার উর্বর ভূমি। এমনটাই আমদের প্রত্যাশা।’

তবে ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে এখন কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান। তদন্ত প্রতিবেদন জমার বিষয়টি গণমাধ্যমে জেনেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে যে খবর আসছে, সেই প্রেক্ষিতে সরকার ও জাতির কাছে আমার অবস্থান ক্লিয়ার করার জন্য আগামী রবিবার (২৫ অক্টোবর) সংবাদ সম্মেলন করবো।’

স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0045530796051025