শৈশব-কৈশোরে বেড়ে ওঠা প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে চলে যেতে হবে আর কিছুদিনের মধ্যে। প্রিয় স্কুল আর খেলার মাঠে আর যাওয়া হবে না মাস্টার্সের ছাত্রী শারমিন সুলতানা শিল্পীর। সোঁদা মাটির গন্ধ গায়ে নিয়ে রামনাবাদ নদের পারে বেড়ে ওঠা শিল্পীর গন্তব্য কোথায় হবে এখনও জানা হয়নি। কিন্তু পরিবারের পাশে দাঁড়াতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ শিল্পী অতীত ভুলে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়ে এখনই কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়।
পটুয়াখালীর কলাপাড়ার লালুয়া ইউনিয়নের এগার নম্বর হাওলা গ্রামের এই শিক্ষার্থীর মতো চার হাজারেরও বেশি পরিবারের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রী ও কর্মক্ষম যুবারা এখন স্বাবলম্বী হতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে। অথচ এরা কিছুদিন আগেও কেউ নদীতে মাছ ধরত, কেউ বা দিনমজুর হিসেবে কাজ করত। তাদের সবারই লক্ষ্য অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া এবং শিক্ষিত হওয়া।
পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় পায়রা সমুদ্র বন্দর নির্মাণে চারটি ইউনিয়নে প্রায় সাত হাজার একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এ জমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের চার হাজার দুইশ নারী-পুরুষকে ক্ষতিপূরণ দেয়াসহ দেশে এবারই প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার থেকে একজন করে সদস্যকে ৩৫টি ট্রেডে প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মক্ষম ও স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ নিয়েছে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ। শিল্পীর মতো ১৩৬ সদস্যের মধ্যে প্রথম দফার তিন মাসের প্রশিক্ষণ শেষে গত সোমবার (৩ ডিসেম্বর) সনদপত্র বিতরণ করা হয়েছে।
লালুয়া ইউনিয়নের মেয়ে শিল্পীর মতো জমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত কলেজ ছাত্রী মাসুমা আক্তার, মারুফা, সালমা জাহান, তহমিনা আক্তার, মুক্তা খানম, খাদিজা আক্তার, ছালমা জাহান, নাবিলা তাবাসসুম ও জান্নাতুল ফেরদৌস রিয়া। কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এরা সম্পন্ন করেছে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কোর্স। তাঁদের সাথে কথা হয় তাঁদের দেখা ভবিষৎ স্বপ্ন নিয়ে। পটুয়াখালী সরকারি কলেজের মাস্টার্সের ছাত্রী শারমিন সুলতানা শিল্পী বলেন, পায়রা সমুদ্র বন্দর নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ করতে তাদের তিন ও ছয় ধারা নোটিশ দেয়া হয়েছে। সাত ধারা নোটিশ পেলেই তাদের ছাড়তে হবে ছোট থেকে বেড়ে ওঠা প্রিয় ঘরটি। তাদের মতো এগার নং হাওলা গ্রামের মানুষকে এ জমি অধিগ্রহণের কারণে ঘর ছাড়তে হবে।
তার ভাষায়, ‘সরকার জমি নিলেও তাদের পুনর্বাসন করার জন্য যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে তাতেই খুশি। কম্পিউটার প্রশিক্ষণ পাওয়ায় এখন চাকরি না পেলেও গ্রামের কোন বাজারে দোকান দিয়ে পরিবার নিয়ে চলতে পারবেন। নিজে লেখাপড়া শিখেছেন। সরকার প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দিয়েছে। ৩০ হাজার টাকাও পেয়েছেন প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে। এখন একটি কম্পিউটার কিনে ভবিষ্যৎ গড়ায় নিয়োজিত হবো।’
শিল্পী বলেন, তার ভাই নিপু তালুকদার ঢাকায় মাস্টর্সের ছাত্র। ছোট বোন সাজেদা সুলতানা এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। পিতা আফজাল হোসেন একজন কৃষক। জমি অধিগ্রহণের কারণে তাদের চাষের জমি হয়তো থাকবে না। সরকার জমির মূল্যও পরিশোধ করবে। কিন্তু এই কম্পিউটার প্রশিক্ষণ পাওয়ায় এখন হয়তো আর বেকার থাকতে হবে না।
বড় পাঁচ নম্বর গ্রামের এইচএসসি পাশ করা মাসুমা আক্তার বলেন, বড় বোনের বিয়ে হলেও ভাই জহিরুল ইসলাম এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। ছোট বোন কল্পনা পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। পরিবারের উপার্জন বলতে চাষের জমি। পায়রা বন্দর নির্মাণেতাদের জমি অধিগ্রহণ হবে। সরকার জমি অধিগ্রহণের আগেই তাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী করার সুযোগ করে দেয়ায় সে এখন খুশি।
একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতি পরিবার থেকে একজন করে সদস্যকে কম্পিউটার, মটর ড্রাইভিং ও রাজমিস্ত্রির প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। ৩ ডিসেম্বর পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমোডর মো. জাহাঙ্গীর আলম এ প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে সনদপত্র বিতরণ করেন।
পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমোডর মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পায়রা বন্দরে ২০২১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ২২ হাজার কোটি টাকার মধ্য মেয়াদি প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হবে। তাই জমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের শিক্ষিত ও কর্মক্ষম নারী-পুরুষকে প্রশিক্ষণ দেয়ার বিকল্প নেই। প্রশিক্ষণ নিয়ে এ শিক্ষিত যুবারা পায়রা বন্দরে উন্নয়নমূলক কাজে অংশ নেবে। তাই প্রথম ধাপে তিনমাস মেয়াদি ১৩৬ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আগামী তিন বছরে ৪,২০০ জন নারী-পুরুষকে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে শুধু প্রশিক্ষণই নয়, পুনর্বাসনের জন্য পাকা ঘরও বরাদ্দ দেয়া হবে।