র‌্যাগিং ও বিশ্ববিদ্যালয় - দৈনিকশিক্ষা

র‌্যাগিং ও বিশ্ববিদ্যালয়

শ্যামল কুমার সরকার |

বর্তমান সময়ে র‌্যাগিং শব্দটি বেশ পরিচিত হয়ে উঠছে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এ অপসংস্কৃতি দিন দিন পোক্ত হচ্ছে। ইংরেজি Rag শব্দটির আভিধানিক অর্থ কাউকে জ্বালাতন করা, রসিকতার নামে কাউকে অত্যাচার করা এবং ৎধম-ফধু শব্দটির আভিধানিক অর্থ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা জীবনের সমাপ্তিতে আনন্দ-উৎসব। rag-day ধারণাটির সূচনা পশ্চিমা দেশে। এটি একটি ভালো উদ্যোগ। কয়েক বছর পাশাপাশি থাকার পরে শিক্ষার্থীরা হৈ-হুল্লোড়ের মাধ্যমে আনন্দে মেতে ওঠে। সেদিন বর্ণিল সাজে শিক্ষার্থীরা নিজেদের সাজায়, চিৎকার-চেঁচামেচি করে, আনন্দ করে এমনকি কাঁদেও। শিক্ষার্থীদের মননের বিকাশে দিনটি অর্থবহ। 

শিক্ষা জীবন শেষে বহু বছর পরেও শিক্ষার্থীরা ‘র‌্যাগ-ডে’র কথা ভেবে আনন্দ-বেদনার অনুভূতি ভাগাভাগি করে। কিন্তু র‌্যাগিং অপকর্মটির প্রয়োগ শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশ্বের কোথায় কখন শুরু হয়েছে তা সঠিকভাবে বলা মুশকিল। তবুও বলা হয়ে থাকে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত হতেই এটি আমদানি হয়েছে। বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এর ব্যাপক চর্চা চলে বলে জানা যায়। এমনকি র‌্যাগিং নিয়ে ভারতে শিক্ষার্থীদের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে বলে শোনা যায়। হায় রে সভ্য দুনিয়া! বাংলাদেশে ৯০-এর দশক পর্যন্ত র‌্যাগিং বিষয়টি প্রায় ছিলই না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে আমি একে দেখিনি। আমরা র‌্যাগ-ডে উদযাপিত হতে দেখেছি এবং পালনও করেছি। অথচ একবিংশ শতকের বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে র‌্যাগিং নামের দানবটি ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে উঠছে। 

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে গত বছর আলোচিত ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। মিডিয়াতে সেখানকার একাধিক ঘটনার খবর এসেছিল। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও বিচ্ছিন্নভাবে র‌্যাগিং এর ঘটনা ঘটেছে। শোনা যায়, র‌্যাগিংয়ের মাধ্যমে সিনিয়ররা জুনিয়রদের নানাভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে। শারীরিক নির্যাতনের মধ্যে আছে কান ধরে ওঠ-বস করানো, রড় দিয়ে পেটানো, পানিতে চুবানো, উঁচু ভবন হতে লাফ দেওয়ানো, সিগারেটের আগুনে ছ্যাকা দেয়া, গাছে ওঠানো, ভবনের কার্নিশ দিয়ে হাঁটানোসহ দিগম্বর করা পর্যন্ত। আর মানসিক নির্যাতনের মধ্যে আছে গালিগালাজ করা, কুৎসা রটানো, নজরদারি করাসহ নিয়মিত খবরদারি করা। এর ফলে অনেক শিক্ষার্থী আতঙ্কে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যায়। কাউকে কাউকে ডাক্তারের শরণাপন্নও হতে হয়। অনিশ্চিত হয়ে যায় তাদের কাক্সিক্ষত শিক্ষা জীবন। এ কেমন দাদাগিরি? ক্যাম্পাসে এসেই যদি জুনিয়ররা বড়ভাইদের এসব কার্যকলাপ দেখে তাহলে ওরা শিখবে কি? বিষয়টি শুধু বিকৃত না অমানবিকও বটে। আর আইনগতভাবেও এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ-মানবাধিকার লঙ্ঘন। তবুও পৈশাচিক খেলাটি চলছে। ছাত্ররা র‌্যাগিংয়ের শিকার বেশি হলেও ছাত্রীরাও এর বাইরে নয়। ছাত্রীরা কার সঙ্গে মিশবে বা মিশবে না তা নাকি বড় ভাইরা-আপুরা বলে দেয়।

আবার র‌্যাগিংয়ের জুজুর ভয় দেখিয়ে পরিবার-পরিজন থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখে এমন ছাত্রীও আছে। এরা মূলত নিজের অপকর্মকে গোপন রাখতেই মা-বাবাসহ স্বজনদের ক্যাম্পাসে না নেয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। মা-বাবা সন্তানকে বিশ্বাস করে বড় ভুল করেন যা ধরা পড়ে সর্বনাশের পরে। এ নিবন্ধটি লেখার আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ভিন্ন ভিন্ন কথা। ছাত্রদের বক্তব্য র‌্যাগিং বলতে এখানে তেমন কিছু নেই। নবীনদের শুধু দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়। মিডিয়া বাড়িয়ে বলে। ছাত্রীদের বক্তব্য সিনিয়রদের কারণে নিজের ভাইয়ের সঙ্গেও খোলামেলা কথা বলা দায়। 

ব্যক্তিগতভাবে একাধিকবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। নবীনবরণ অনুষ্ঠানে গেস্ট হয়ে অনেক রাত পর্যন্ত সেখানকার অনুষ্ঠানে থেকেছি। সেখানে ছেলেমেয়েদের প্রাণবন্ত অংশগ্রহণ দেখে মেয়েদের বক্তব্যের ব্যাপারে ভেবেছি। যা হোক, র‌্যাগিং একটি জঙ্গলের সংস্কৃতি। ডিসকভারি অথবা এনিমেল প্লানেট চ্যানেলের জঙ্গলি প্রাণীদের খেলা। একবিংশ শতাব্দীর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব চলতে দেয়া যায় না। বিকৃত রুচির কিছু বিপথগামী তরুণ-তরুণীর কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক শিক্ষার পরিবেশ কোনভাবেই বিঘ্নিত হতে পারে না। এবারের ভর্তির কার্যক্রম চলছে। কাজেই প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে র‌্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে এখনই শক্ত অবস্থান নিতে হবে। নবীন শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করে শিক্ষার ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি করা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈতিক দায়িত্ব।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, ঝিটকা খাজা রহমত আলী কলেজ

[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন]

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0059020519256592