র‌্যাগিংয়ের ভূত তাড়াতে যে সরিষা জরুরি - দৈনিকশিক্ষা

র‌্যাগিংয়ের ভূত তাড়াতে যে সরিষা জরুরি

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

সাম্প্রতিক সময়ে পত্রপত্রিকায়, সংবাদমাধ্যম এবং গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র‌্যাগিংয়ের ভয়াবহ চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে। শুধু ছাত্ররাই নয়, র‌্যাগিংয়ের শিকার হন ছাত্রীরাও। র‌্যাগিংয়ের নামে নির্দয়, নিষ্ঠুর নির্যাতন ছাড়াও অশ্নীল, অসামাজিক কার্যকলাপ পর্যন্ত ঘটেছে। গত বছর ২০১৮ সালে সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র‌্যাগিংয়ের ওপর জরিপ পরিচালনা করে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৮৪ ভাগ শিক্ষার্থী র‌্যাগিংয়ের শিকার হয়েও তারা কোনো অভিযোগ জানাননি। শতকরা ৫৬ ভাগ শিক্ষার্থী বলেছিলেন, র‌্যাগিং তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের কঠিন বাস্তবতাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর তা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। ৯০ ভাগ শিক্ষার্থী বলেছেন, র‌্যাগিং খুবই নির্দয়, নিষ্ঠুর ও অমানবিক। লক্ষণীয়, ৭০ ভাগ শিক্ষার্থীর মধ্যে বড়দের ভয়ে ছোটরা র‌্যাগিংয়ের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তবে র‌্যাগিংয়ের নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত হলেও ফৌজদারি আইনে কোনো সুনির্দিষ্ট শাস্তির ব্যবস্থা অনুপস্থিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুরোনো শিক্ষার্থীদের সখ্য গড়ে তোলার জন্য যে আনুষ্ঠানিক পরিচিতি প্রথা সেটাকেই র‌্যাগিং বলে অভিহিত করা হলেও তা দেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রসিকতার ছলে র‌্যাগিংয়ের নামে যে প্রথা চলছে, তা এক কথায় টর্চার সেলে নিয়ে নির্যাতনের মতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর ক্যাম্পাসে প্রথম পা রেখেই র‌্যাগিং নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন নবীন শিক্ষার্থীরা। এ নির্যাতনে পিছিয়ে নেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ভুক্ত সরকারি কলেজগুলোও। শুক্রবার (২২ নভেম্বর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, র‌্যাগিংয়ের নামে নবীন শিক্ষার্থীদের ওপর চালানো হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। যেভাবে র‌্যাগিং করানো হয় তার মধ্যে আছে, কান ধরে ওঠবস করানো, রড দিয়ে পেটানো, পানিতে চুবানো, উঁচু ভবন থেকে লাফ দেওয়ানো, সিগারেটের আগুনে ছ্যাঁকা দেওয়া, গাছে ওঠানো, ভবনের কার্নিশ দিয়ে হাঁটানো, মুরগি হয়ে বসিয়ে রাখা, ব্যাঙ দৌড়ে বাধ্য করা, সিগারেট-গাঁজা-মদ্যপানে বাধ্য করা, অশ্নীল অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করানো, যৌন অভিনয়ে বাধ্য করা, ছেলেমেয়ে হাত ধরা বা জোর করে আলিঙ্গন করতে বাধ্য করা, অপরিচিত মেয়ে অথবা ছেলেকে প্রকাশ্যে প্রেমের প্রস্তাব দিতে বাধ্য করা, ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে যৌন হয়রানি করা, ম্যাচের কাঠি দিয়ে রুম অথবা মাঠের মাপ নেওয়া, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের মাপ নেওয়া, শীতের মধ্যে পানিতে নামিয়ে নির্যাতন করা, পুরোনো শিক্ষার্থীদের থুথু মাটিতে ফেলে নতুনদের তা চাটতে বলা, বড় ভাইদের পা ধরে সালাম করা, গালাগাল করা, নজরদারি করা, নিয়মিত খবরদারি করার মতো নির্দয়, নিষ্ঠুর ও অমানবিক কর্মকাণ্ড। র‌্যাগিংয়ের মতো অপদস্থ ও নির্যাতনমূলক আচরণে অনেক শিক্ষার্থী আতঙ্কে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যায়। কেউ কেউ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে অনেকে আত্মহত্যারও চেষ্টা করে। তা ছাড়া যে শিক্ষার্থী র‌্যাগিংয়ের শিকার হচ্ছে, সে প্রতিরোধপরায়ণ হয়ে পরবর্তী সময় এর চেয়ে বেশি মাত্রায় র‌্যাগিং করার পরিকল্পনা করছে এবং নতুন ছাত্রছাত্রীরা আসার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের ওপর চড়াও হয়- এটা স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনস্তাত্ত্বিকভাবে এটা প্রমাণিত। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে 'চাঁদরাত' বলে একটা কথা আছে। সে রাতে নির্যাতনের বিভীষিকা নেমে আসে হলে হলে। আবাসিক শিক্ষার্থীদের এই বিশেষ র‌্যাগিংয়ের মধ্যে নিহিত আছে অনেক মর্মান্তিক ঘটনার বর্ণনা।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে র‌্যাগিংয়ের ভয়াবহতা দিন দিন যেভাবে বাড়ছে, তাতে মনে হতে পারে সমাজে নতুন এক ব্যাধি ধীরে ধীরে জাতির মেধাবী সন্তানদের গ্রাস করে কঠিন আকার ধারণ করছে। প্রত্যেক মানুষের বয়সের আলাদা আলাদা গুরুত্ব আছে। যেমন- শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রাপ্ত বয়স, বার্ধক্য- প্রত্যেক সময়েরই রয়েছে আলাদা সৌন্দর্য। কিন্তু নানা বিবেচনায় ১৬ থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত বলা হয় জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়- যখন মানুষ স্বপ্ন দেখে, বিকশিত হয়, ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে, ঝুঁকি নিতে পারে, যুদ্ধে যেতে পারে, ফুল ফুটাতে পারে, ভালোবাসতে শেখে, দেশপ্রেম গাঢ় হয়। সাহস-সততা, প্রতিশ্রুতি আর ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত থাকে শরীর-মন। আমরা যারা হলে-হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করেছি, সেই মধুময় স্মৃতি মনে হলে নস্টালজিয়ায় ভরে যায় মন- মনে হয় আবার যদি ফিরে যেতে পারতাম। আর এখন মনে হয়, শিক্ষার্থীরা ভাবে কবে এ বিভীষিকা থেকে বেরোতে পারব। পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক চর্চা, ক্রীড়া, বিতর্ক, প্রাণবন্ত আড্ডা- সবই হয়ে গেছে সীমিত। মনে হয় ক্যাম্পাসে শুধু পালিয়ে থাকা, আড়ালে থাকা। যারা নির্যাতিত হচ্ছে আর যারা নির্যাতন করছে সবাই আমাদের সন্তান, দেশের পরীক্ষিত মেধাবী সন্তান। তাদের সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ থাকার কথা, অথচ এখন এরা হতাশা-যন্ত্রণায় নিমজ্জিত। সবাই হয়ে যাচ্ছে মানসিক বিকারগ্রস্ত- ভবিষ্যতে তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, পেশাগত, সামাজিক জীবনে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। ধীরে ধীরে সমাজও হয়ে পড়বে অসুস্থ, সংকটময়।

এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের এগিয়ে আসতেই হবে। তারাই প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রক, অভিভাবক ও আদর্শের প্রতীক। কিছু কিছু শিক্ষকের দলাদলি, অনৈতিক আকাঙ্ক্ষা এবং অতিমাত্রায় রাজনীতিমুখীনতা পরিবেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। যে কোনো পরিস্থিতিতেই ছাত্রদের সামনে শিক্ষকদের মর্যাদা সমুন্নত রাখতেই হবে। শিক্ষকরা কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই শিক্ষক নন, তারা দেশ ও জাতিরও শিক্ষক। সে কারণে যুগে যুগে, দেশে দেশে শিক্ষকদেরই মর্যাদার সর্বোচ্চ আসন দেওয়া হয়। সে মর্যাদা আমরা কতটা রক্ষা করতে পারছি- সেটি এ সময়ের একটি বড় প্রশ্ন? এ পরিস্থিতিতে আমাদের নতুন প্রজন্মের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষাবান্ধব সুষ্ঠু পরিবেশের জন্য তিনটি প্রস্তাবনা উপস্থাপন করছি।

প্রথমত, যে কোনো পরিস্থিতিতেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনকে সর্বোময় ক্ষমতার অধিকারী হতে হবে। তাদের হতে হবে নিরপেক্ষ, নিয়মতান্ত্রিক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিধি-প্রবিধির অনুসারী। তাদের প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে সিনেট, সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল এবং ফ্যাকাল্টির মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে, না হলে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হবে। শিক্ষকদের ছাত্রদের প্রশ্নে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে এবং প্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ এবং সহযোগী থাকতে হবে। ছাত্র-শিক্ষক সুসম্পর্ক এবং আস্থা ক্যাম্পাসের সুষ্ঠু পরিবেশের অপরিহার্য উপাদান।

তৃতীয়ত, শিক্ষকদের প্রকাশ্যে রাজনীতি এবং দলাদলি করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কোনোক্রমেই  ছাত্রদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করা যাবে না। সব ছাত্রই যেন তাদেরকে অভিভাবক মনে করতে পারে। শিক্ষার্থীর পাঠ গ্রহণে এবং শিক্ষকদের পাঠদানে (সব শিক্ষা কার্যক্রমে) অনিয়মের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের আপস বা গাফিলতি গ্রহণযোগ্য হবে না। বিশ্ব অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের চ্যালেঞ্জ আরও কঠিন। সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের নতুন প্রজন্মকে প্রস্তুত করতে হবে, রক্ষা করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ রক্ষা করে নতুন প্রজন্মকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া আমাদের সবার দায়িত্ব।

ডা. কামরুল হাসান খান : অধ্যাপক; সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0041439533233643