'ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ'-প্রবাদটি আজকাল এক রকম নির্বাসিত। 'ছাত্র জীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য' নামের রচনা মুখস্ত করতে গিয়ে প্রবাদটি কতবার পড়েছি আর খাতায় লিখেছি সে হিসেব সঠিক করে বলতে পারব না। শুধু তাই নয়, প্রবাদটি চিরন্তন সত্য বলে সর্বদা মেনে নিয়েছি এবং মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছি। আজও করি।
বর্তমান সময়ে ক'জন শিক্ষার্থী প্রবাদটি জানে? শতে পাঁচ জনেও জানে কি না সন্দেহ হয়। লেখাপড়া নিয়ে তাদের মাথা ব্যথা নেই। বই পড়ার অভ্যাসটি দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে। পাঠ্য পুস্তকে আগ্রহ নেই। স্কুল, কলেজ এমন কী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীরাও অধ্যয়নে তেমন আগ্রহ দেখায় না। এটি নিঃসন্দেহে গোটা জাতির জন্য দুশ্চিন্তার আরেক বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে প্রায় সব শিক্ষকের এক কথা-ছাত্রছাত্রীরা পড়া শিখে আসে না। বাড়ির কাজ দিলে একটুও করে না। ক্লাসে অমনোযোগী থাকে। অভিভাবকদেরও একই অভিযোগ, ছেলেমেয়েরা বাড়িতে মোটেই পড়াশোনা করে না। বই নিয়ে পড়ার টেবিলে বসে না। স্কুল-কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে এসে আড্ডা ইয়ার্কিতে ব্যস্ত থাকে। সারা রাত মোবাইল নিয়ে টিপাটিপি করে। ছেলেদের মাথায় চুলের রং ঢং আর মুখে দাড়ির নমুনা দেখে বাবা-মা'র ও মেজাজ নষ্ট। বড়দের সম্মান করা আর ছোটদের স্নেহ করার অভ্যাস তাদের মাঝে গড়ে ওঠেনি। মুরব্বি কিংবা বয়োজ্যষ্ঠ লোকদের এতটুকু শ্রদ্ধা করে না। করবে কেন? বাবা-মা ও শিক্ষককে যে সম্মান করতে শেখেনি, সে কী করে অপরিচিত কাউকে শ্রদ্ধা করবে? 'শ্রদ্ধাবান লভে জ্ঞান, অন্যে কভু নয়'-এ কথার ধার ধারে না তারা। উঠতি প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যদি এভাবে বেড়ে ওঠে, তাহলে জাতির ভবিষ্যত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
গত শতাব্দীর শেষের দশকে নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন পদ্ধতি চালু হবার পর থেকে লেখাপড়ায় প্রথম ধস নেমে আসে। লেখাপড়া না করে কেবল টিক চিহ্ন দিয়ে দিয়ে কতজনে এসএসসি পাস করেছে, সে হিসেব কার কাছে আছে? এরপর সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালু হবার পর থেকে লেখাপড়া একদম শিকেয় উঠে যায়। যা তা লিখলেই পাস নম্বর মেলে। বৃত্ত ভরাটে একটু সতর্ক হলেই হলো। গত কয় বছর পরীক্ষায় পাসের হার অপ্রত্যাশিতভাবে বেড়ে যাবার কারণে ছাত্রছাত্রীরা একদম লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে। শিক্ষকরা আজকাল তাদের একদম শাস্তি দিতে পারেন না বলে তারা দিনে দিনে অধ্যয়ন বিমুখ। শিক্ষকের শাস্তির ভয় নেই বলে শিক্ষার্থী একদম বেপরোয়া । অভিভাবককে থোরাই কেয়ার করে। অভিভাবকও এক রকম অসহায়। শক্ত করে কিছু বলতে সাহস পান না। শিক্ষকরা তো অনেক আগেই অসহায় হয়ে গেছেন। শিক্ষার্থীর শিক্ষকের শাসনের ভয় নেই। উল্টো শিক্ষক নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। এক সময় অভিভাবকরা সন্তানকে শিক্ষকের ভয় দেখিয়ে পড়াশোনায় বসতে বলতেন। স্কুলে যেতে বলতেন। এখন আর সেদিন নেই। শিক্ষক এক আধটু শাস্তি দিলে অভিভাবক উল্টো ক্ষেপে যান। শিক্ষকের বিরুদ্ধে থানা-পুলিশ কিংবা আদালত পর্যন্ত যেতে ভ্রুক্ষেপ করেন না। 'শিক্ষকের মারধর বেহেস্তে যায়' কিংবা 'হাড্ডি শুধু আমার আর মাংসটুকু আপনার'-এসব কথা আজকাল অভিভাবকের মুখে শোনাই যায় না।
এ অবস্থায় শিক্ষার্থী কোন গরজে লেখাপড়া করবে? আমাদের কারিকুলাম এবং সিলেবাসের অসঙ্গতির কারণেও লেখাপড়ায় ছেলেমেয়েদের মন বসে না। শিক্ষার্থীর বয়স, মেধা, রুচি, পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় না নিয়ে কারিকুলাম ও সিলেবাস প্রণয়ন করা হয়। পাঠ্যপুস্তকে শিক্ষনীয় বিষয় ও নীতি-নৈতিকতার চরম ঘাটতি। এ রকম নানা কারণ। কারণ যাই হোক না কেন, আজকালের ছেলেমেয়েরা আগের দিনের ছেলেমেয়েদের মত পড়াশুনায় মনযোগি নয়-সে বিষয়ে সকলে একমত। আমাদের লেখাপড়ায় এখন একেবারে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। ভাল করে ইংরেজি কিংবা বাংলা বর্ণ লিখতে জানে না, এমন শিক্ষার্থীরা পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষায় পাস করে বসে। কোনো কোনো সময় জিপিও-৫ ও পেয়ে যায়। পরীক্ষার হলে দেখাদেখি আর মাতামাতি করেও অনেকে পাস হয়ে যায়। আজকাল নীতি-নৈতিকতা সম্পন্ন আদর্শ ও দক্ষ শিক্ষকের একান্ত অভাব বলেই শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় মনোযোগ দেয় না। নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের দেখা মেলা ভার। অনেকে শ্রেণিকক্ষের চেয়ে কোচিং ক্লাসে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সব মিলে পড়ালেখার এখন চরম দুর্দিন।
একটি ছোটগল্প দিয়ে আজকের লেখাটি শুরু করতে চেয়েছিলাম। গল্পটি এ রকম-এক ছাত্রকে স্কুলে শিক্ষক ইংরেজি পড়াবার সময় my head অর্থ 'আমার মাথা' শিখিয়ে দিয়েছেন। সে মনে করেছে-স্যার যেহেতু 'আমার মাথা' বলেছেন তাহলে সেটি 'স্যারেরই মাথা' হবে। সন্ধের পর বাড়ি গিয়ে পড়তে বসে সে মুখস্ত করতে শুরু করে- my head অর্থ 'স্যারের মাথা', my head অর্থ 'স্যারের মাথা'। রান্না ঘর থেকে শুনে রাগে গড়মড় করে মা এসে বলেন-এই গাধা, এ কি পড়ছ? my head অর্থ 'স্যারের মাথা' নয়। my head অর্থ 'আমার মাথা'। এবার ছাত্রটি ভেবেছে তাহলে বোধ হয় মাথাটি তার মায়ের। মা চলে গেলে সে পড়তে থাকে-my head অর্থ 'আম্মার মাথা', my head অর্থ 'আম্মার মাথা'। ইত্যবসরে বাবা এসে ঘরে ডুকেই শুনতে পান ছেলে জোরে জোরে পড়ছে-my head অর্থ 'আম্মার মাথা', my head অর্থ 'আম্মার মাথা'। বাবা রাগত হয়ে ধমকের স্বরে বলেন -একি পড়ছো তুমি? my head অর্থ 'আম্মার মাথা' নয়। my head অর্থ 'আমার মাথা'। এবার বাবা চলে গেলে সে মনে করে মাথাটি বোধ হয় তার বাবার। তাই জোরে জোরে পড়তে শুরু করে- my head অর্থ 'আব্বার মাথা', my head অর্থ 'আব্বার মাথা'। অনেকক্ষণ এভাবে পড়তে পড়তে সে অনেকটা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এমনি সময় বড় বই বাড়ি এসে তার পড়া শুনতে পায় । তখনো সে আওড়িয়ে যাচ্ছে-my head অর্থ 'আব্বার মাথা', my head অর্থ 'আব্বার মাথা'। এ শুনে ভাইয়ের মেজাজ বিগড়ে যায়। ঘরে ঢুকেই দাঁত কিটমিট করে বলে-'এই খবিস, এ কি পড়ছিস ? my head অর্থ 'আব্বার মাথা' নয়। my head অর্থ 'আমার মাথা'। এবার ছেলেটির মন মেজাজ একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। সে ভাবে, my head অর্থ আর কত জনের মাথা হবে? একজনের মাথা বললে আরেকজনের মন খারাপ। এবার সে একটা বুদ্ধি বের করে। সবাইকে খুশি করার বুদ্ধি। এবার সে জোরে জোরে পড়তে থাকে-my head অর্থ 'আমার চৌদ্দ গোষ্ঠীর মাথা', my head অর্থ 'আমার চৌদ্দ গোষ্ঠীর মাথা', my head অর্থ 'আমার চৌদ্দ গোষ্ঠীর মাথা' my head অর্থ----। সে ভাবে-এখন সবাই খুশি হবে। কারো মন বেজার থাকার আর কিছু নেই। যেই আসুক আর কেউ তাকে বকা দেবে না। সবাইকে খুশি রাখার জন্য সে আরো জোরে জোরে পড়তে থাকে-my head অর্থ 'আমার চৌদ্দ গোষ্ঠীর মাথা'।
আজকাল আমাদের ছাত্রছাত্রীরা সে দশায় পড়েছে কি না কে জানে? ঘন ঘন কারিকুলাম ও সিলেবাস বদল হয়। রদবদল হয় পাঠ্যপুস্তকও। বদলে যায় পরীক্ষা পদ্ধতি এবং প্রশ্নের ধারা। পরীক্ষার মাত্র দু'মাস আগেও এমনটি ঘটে থাকে। কেবল শিক্ষার্থী নয়, শিক্ষকরাও বিভ্রান্ত হয়ে যান। অভিভাবকও পড়ে যান বিভ্রান্তিতে। এ করে করে নতুন প্রজন্মের কাছে লেখাপড়া এক 'বাড়তি ঝামেলা' হয়ে গেছে কি না, সেটা আজ খুব ধীরে সুস্থে ভেবে দেখা আমাদের সবার জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
লেখক: অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট ও দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।