লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হোক - দৈনিকশিক্ষা

লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হোক

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

কতটা কষ্ট দিয়ে ওরা আদরের সন্তান আবরারকে মেরেছে। প্রাণপ্রিয় মায়ের নিজ হাতে কোলেপিঠে নিয়ে তিল তিল করে গড়ে তোলা শরীর, কতভাবে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে মেরে মেরে রক্তাক্ত করেছে পাষণ্ডরা? একজন মা কীভাবে তার প্রাণপ্রিয় সন্তানের ক্ষতবিক্ষত, থেতলানো শরীরের কথা মনে করে সুস্থ থাকতে পারবেন? আবরার কি বাঁচার জন্য চিৎকার করে আর্তনাদ করেনি? আবরারের মমতাময়ী মা শতভাগ নিশ্চিত; তার আদরের ধন, নির্যাতনের কষ্টে-যন্ত্রণায় বারবার মা-মা বলে ডেকেছে। মা একথা ভেবে কি করে সুস্থ থাকবেন, তার কলিজার টুকরো আবরার কি মৃত্যুর সময় পানি খেতে চায়নি? পরীক্ষা বলে ঘুমন্ত আবরারকে ‘বাবা-বাবা’ বলে জাগিয়ে তুলে তার প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পাঠিয়েছেন মা। নিজেও গিয়েছিলেন গাড়িতে উঠিয়ে দেয়ার জন্যে। এখন সে মা আর কাকে বাবা-বাবা বলে ডাকবেন। নারীছেরা সন্তান আবরারের মুখেও আর কখনো ‘মা’ বলে ডাক শুনতে পাবেন কী? পৃথিবীর কোনো মা এটা মনে করে সুস্থ থাকতে পারবে কী? রোববার (১৩ অক্টোবর) সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন মোহাম্মদ আবু নোমান।

নিবন্ধে আরও বলা হয়, যেভাবে মা পাখিটা রোদ-বৃষ্টি, কাক-চিলের হাত থেকে রক্ষার জন্য পালক দিয়ে তার ছানাকে আগলে রাখে। ঠিক সেরকম প্রতিটি মা-বাবা সন্তানকে আগলে রাখে। মায়ের কাছে সন্তান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ। প্রতিটি মা ভালোবাসা ও মমতার চাদরে জড়িয়ে সন্তানকে লালন করেন। আবরারের লাশ বাড়িতে আসার পর বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন শোকে পাগলপ্রায় মা রোকেয়া খাতুন। কারণ, তিনি মা। তার মমতা ছিলো অতুলনীয়। একমাত্র ভাই ফাইয়াজ যেন পাগল হয়ে গেছেন। কোনো কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না ভাইয়ের এই নির্মম মৃত্যু। আমরা কোন সমাজে বাস করছি! তাহলে কী মানুষের কোন মূল্য নেই? দেশে আইন-কানুন এবং এর প্রয়োগকারীরা কোথায়? আইনের কতটুকু প্রয়োগ হয়?

একজন সন্তানকে বড় করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠানোর দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়া এ দেশে কী বিরাট যুদ্ধ; সেটা শুধুমাত্র ভুক্তভুগি মা-বাবাই জানেন। আর যে ছেলে দেশের সবচেয়ে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছে, তাকে এবং তার মা-বাবাকে কতটা যুদ্ধ করতে হয়েছে- আর সে যুদ্ধ যখন এভাবে শেষ হবে তা মানা যায় কী?

বুয়েট একটি অহংকারের নাম। বুয়েট হচ্ছে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে বুয়েটকে সর্বোচ্চ স্ট্যান্ডার্ড ধরা হয়। দেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের একটা অংশই বুয়েটে ভর্তি হয়ে থাকেন। যেখানে সন্তানরা ভর্তির সুযোগ পেলে মা-বাবা গর্ব বোধ করেন, স্বপ্নের জাল বুনেন। কিন্তু এখন বুয়েটে অবিভাবকহীন অবস্থা বিরাজ করছে। যেখানে সন্তানের জীবনের সামান্যতম নিরাপত্তা নেই! যেকোন ছুঁতোয় সহজেই খুন হয়ে যাবে কষ্টের সন্তান! ভেঙে চুরে যাবে সমস্ত স্বপ্ন! এ কোন দেশে বাস করছি আমরা!

সম্প্রতি মানুষের প্রতি মানুষের হিংস্রতা এতবেশি প্রকট আকার ধারণ করছে, যার জন্য মানুষ আর পশুতে কোন ভেদাভেদ থাকছে না। ওদের ভেতরে কি একটুও মায়া হলো না! ওরাওতো একজন মায়ের সন্তান। পশুর মধ্যেও এত হিংস্রতা নেই, যতটা মানুষের মধ্যে দেখা যায়। এ ধরণের সংবাদ শোনার পর বিশ্বাস হয় না যে আমরা মানুষ। মানুষের মধ্যে পশুর মত এমন হিংস্রতা সত্যি মেনে নেয়া যায় না। মানুষ আর পশু এক নয়। মানুষের বোধশক্তি আছে, যেটা কিনা একটা পশুর নেই। কোন কাজটা করলে ভালো হবে, আর কোনটা করলে খারাপ হবে এই বোধটুকু প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই থাকে, যেটা কিনা একটা পশুর মধ্যে থাকে না। কিন্তু বর্তমানে মানুষ এতবেশি হিংস্র আর বর্বর হয়ে গেছে, তার মধ্যে বিচার বিবেচনা বোধটুকুও লোপ পেয়েছে। ওই সমস্ত মানুষগুলাকে পশুর সাথে তুলনা করা ছাড়া আর কি বলা যায়?

আজকে যদি সব খুনিদের ফাঁসিও হয় তাতে আবরারের কি লাভ হবে? ওর মা-বাবা কি তাদের ছেলেকে ফিরে পাবেন? বলার, লেখার বা প্রতিবাদের ভাষা নেই! ২০/২২ বছরে কতিপয় শিক্ষার্থী কি করে একই প্রতিষ্ঠানের সহশিক্ষার্থীদের এভাবে মারতে পারে! প্রকৃত মানুষ হলে তো একটা কুকুরের গায়েও আঘাত করতে হাত কেঁপে ওঠার কথা। বুয়েটের বেদনাদায়ক খবরে সকলেরই নির্বাক হওয়ার মতো অবস্থা। আমরা কি অন্ধকারের দিকে যাচ্ছি? এ কেমন বর্বরতা, মানবতা কোথায় গিয়ে দাড়িয়েছে আজ!

আবরারকে যারা নিজের হাতে পিটিয়েছে। তারা কেউ খুনি বা ক্রিমিনাল ছিলো না। তাদের পিতা-মাতাও খুনি নয়। খুন করতে বা খুনি হতে সন্তানকে বুয়েটে পাঠায়নি। সন্তানকে নিয়ে তারাও অনেক বড় স্বপ্নের জাল বুনে আছেন। আবরারের মা-বাবার আজকে কষ্টের যে অবস্থান, খুনীদের পিতা-মাতার অবস্থানও প্রায় একই রকম। আবরারের খুনিদের বড় পরিচয় তারা কোনো ব্যক্তি নন, একটি দলের। একটি দেশের ও প্রতিষ্ঠানের নেতা-কর্মীদের দ্বারা গঠিত সে দল। ইতোমধ্যে আবরার হত্যাকাণ্ডের আসামি হিসেবে পুলিশ যাদের চিহ্নিত করেছে, তারা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী। ছাত্রলীগ যে শুধু ভিন্নমতের সমর্থকদের হত্যা করে তা নয়, প্রয়োজনে তারা নিজের সংগঠনের বন্ধুদেরও হত্যা করে। পরিসংখ্যানে ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে ছাত্রলীগের নিজেদের কোন্দলে নিহত হন ৩৯ জন। আর এই সময়ে ছাত্রলীগের হাতে প্রাণ হারান অন্য সংগঠনের ১৫ জন। দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা তাদের খুনি বানিয়েছে। সুতরাং, এই হত্যাকাণ্ডের জন্য আমরা কাকে দায়ী করব? লেখার জবাব লেখা দিয়ে করা যায়। যুক্তির জবাব পাল্টাযুক্তি দিয়ে। পড়াশুনো, খেলাধুলা, গবেষণা, মুক্ত চিন্তা, বিতর্ক, এসবইতো বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ। আমাদের অসহিষ্ণুতার পর্যায় কোথায় নেমে গেছে যে, একটা ফেসবুক স্ট্যাটাসের জন্য মেরেই ফেলা হলো! যে ছেলেরা একটা ফেসবুক স্ট্যাটাসকে মেনে নিতে পারে না, সে ছেলেরা দেশ পরিচালনা করবে কীভাবে? আমরা তবে কাদের পড়াই, কাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখি, কাদের হাতে ভবিষ্যৎ? যাকে মারল সে যুবক, যারা মারল তারাও যুবক। এই বয়সীদের মনে এমন হিংস্র মনোভাব কীভাবে তৈরি হলো! এর জন্য আমাদের সমাজ, সামাজিক সংস্কৃতি ও রাজনীতি দায়ী নয় কী?

আবরার, বিশ্বজিৎ, রিফাত সবাইতো প্রকাশ্য হত্যার শিকার। বিশ্বজিৎকে কোপাতে, আবরারকে পেটাতে ওদের হাত বুক কিছুই কাঁপেনি। ওরা এভাবেই দলের কাছে তাদের ক্রিয়াশীলতার প্রমাণ রাখে মাত্র! বাংলাদেশের ইতিহাসে সব সরকারের আমলেই ছাত্র সংগঠনগুলো সর্বদা ভিন্ন মতাবলম্বী রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের সভা-সমাবেশ হলে পণ্ড করা বা ভিন্ন মতাবলম্বী ছাত্র সংগঠনের নেতা কর্মীদের প্রহার কিংবা লাঞ্ছিত করাই যেনো অবশ্যকরণীয় কাজ!

স্বাধীনতা পূর্ববর্তী অধ্যায় ছাড়া ভালো কাজের জন্য ছাত্র রাজনীতি গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে, এমন নজির আছে কী? ছাত্র রাজনীতির নামে মেধাবী ও নিরপরাধ যতো ছাত্র ও সাধারণ মানুষ মারা গেছে, সমস্ত পৃথিবীর ছাত্র সংগঠনগুলোর সে রেকর্ড আছে কী? শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই কেন? গ্রামে-গঞ্জে, পাড়া-মহল্লায়ও এদের উৎপাতের কারণে শান্তি প্রিয় মানুষের থাকাই দায়! ব্যক্তি স্বার্থ হাসিল এবং আসাবাদী মা বাবার বুক খালি করা ছাড়া শিক্ষাঙ্গনের ছাত্র/শিক্ষকদের সংগঠন সাধারণ ছাত্র/শিক্ষকের কোনো কাজে আসে কী?

দেশ যখন পরাধীন ছিল তখন ছাত্র রাজনীতি ছিল সময়ের দাবি। একটি স্বাধীন দেশে ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা কতটুকু তা ভেবে দেখা দরকার। ‘ছাত্র’ এবং ‘রাজনীতি’ শব্দ দুটো একসাথে চলতে পারে না। ধর্ষণে সেঞ্চুরি উৎযাপন, চাঁদাবাজি, ভিন্ন মত রুখতে হত্যা, ধর্ষণ করে ধামাচাপা দেয়া, জনমানুষের মাঝে ত্রাস সৃষ্টি, ছাত্র রাজনীতির এসব রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির বন্ধের এখনই সময়।

জাবির ছাত্রলীগের ঈদের বখশিশ ছিল ২ কোটি টাকা। যেটা আন্তকোন্দলের কারণে প্রকাশ পায়। এমনি হাজারো অপ্রকাশিত বখশিশ আদায়ের খবর দেশে নেই কী? যে দেশে লাখো মানুষ ফুটপাতে, রাস্তায়, রেলস্টেশনে রাত কাটায়। অর্ধাহারের-অনাহারের যন্ত্রণায় নিজের সন্তানকে বিক্রি করে, হত্যা করে। সে দেশে ছাত্রদের চাঁদার দাবী ২ কোটি টাকা, চিন্তা করা যায়?

আমরা তো বলে থাকি দেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে এগোচ্ছে। বাংলাদেশ সারাবিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। আমরা কি এই উন্নয়নের সঙ্গে মানবিকতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছি? উন্নয়নের সঙ্গে সভ্যতা?কে তাল মিলিয়ে চালাতে পারছি? তাহলে আমরা উন্নয়ন বলতে কী বুঝাতে চাচ্ছি? শুধু কি রাস্তাঘাট, ইমারত, ব্রিজ তৈরি?? একজন ভিন্নমত পোষণ করতেই পারেন। তার বিশ্লেষণের সঙ্গে আমরা একমত না হতেই পারি। তাই বলে পিটিয়ে মেরে ফেলা? এমন সামাজিক, রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে যদি আমরা বাস করি, তাহলে প্রশ্ন আসতেই পারে, নিজেদের সভ্য বলে, উন্নত বলে দাবি করছি কীভাবে?

ফাঁসি দিয়ে অপরাধিকে মুছে ফেলা যায়, অপরাধকে মুছে ফেলা যায় না। অপরাধকে মুছে ফেলতে হয় মানবিক মূল্যবোধ দিয়ে। যা সৃষ্টি করেন পরিবারে পরিবারের অভিভাবক, সমাজে সমাজপতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক, রাজনীতিতে রাজনীতিবিদ, সরকারে সরকার প্রধান। এর সঙ্গে একথাও মানতে হবে, শুধু ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ শিক্ষাই যথেষ্ট নয়। কঠারভাবে আইনের শাসন বাস্তবায়নও জরুরি।

দেশে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা সময়ের দাবী। সময় এসেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতির ধরণ-ধারণ পাল্টানোর। নয়তো এই ধরনের সহিংসতা অদূর ভবিষ্যতে আরও ঘটবে। আমরা আর কোনো মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ শুনতে চাই না। আর একজন আবরারকেও যেন অকালে হারিয়ে যেতে না হয়।

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0051560401916504