লড়াকু কন্যা নুসরাত হত্যা মামলার রায় - দৈনিকশিক্ষা

লড়াকু কন্যা নুসরাত হত্যা মামলার রায়

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

জীবনযুদ্ধের এক লড়াকু নারী সোনাগাজীর সোনার কন্যা নুসরাত। কোরআন-হাদিসের জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়ে সমাজকে আলোকিত করার এক স্বপ্ন নিয়ে ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসায় পড়তে গিয়েছিল নুসরাত। নুসরাতের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। প্রতিবাদী নুসরাতের দেহটাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বুকের গভীরে সযতনে লালিত স্বপ্নগুলোকেও পৈশাচিকভাবে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। আগুনে পুড়িয়ে হত্যার আগে নুসরাত ও তার স্বপ্নগুলো মাদরাসার অধ্যক্ষ কর্তৃক শ্লীলতাহানির শিকার হয়। বাংলাদেশে যেখানে শহরাঞ্চলেও যৌন নির্যাতনের অনেক অভিযোগ লোকলজ্জার ভয়ে লুকিয়ে রাখার কথা শোনা যায়, সেখানে মফস্বল শহর এবং রক্ষণশীল পরিবার থেকে আসা এই মেয়েটি তার অভিযোগ নিয়ে আদালত পর্যন্ত গিয়েছে। কী ভয়ংকর দ্রোহের আগুন ছিল নুসরাতের বুকের মধ্যে। শরীরের ৮০ শতাংশ দগ্ধ হওয়ার পর ফেনী থেকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পথে তার ভাইয়ের মোবাইলে রেকর্ড করা এক অডিওতে তাকে বলতে শোনা গেছে, ‘শিক্ষক আমার গায়ে হাত দিয়েছে, শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমি এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করব।’ সমাজ-রাষ্ট্র নারীবান্ধব নয়; বরং নারীর প্রতি বৈরী জেনেও নুসরাত প্রতিবাদ করেছে। শিখিয়ে দিয়ে গেছে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেই হবে। আগুনে ঝলসে মৃত্যু হবে জেনেও প্রতিবাদ চালিয়ে যেতে হবে। শুক্রবার (২৫ অক্টোবর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও বলা হয়, ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসা থেকে এ বছর আলিম পরীক্ষা দিচ্ছিল নুসরাত। গত ৬ এপ্রিল পরীক্ষা দিতে ওই মাদরাসাকেন্দ্রে গেলে পাশের বহুতল ভবনে ডেকে নিয়ে কেরোসিন ঢেলে নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়া হয়। ১০ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যায় নুসরাত। এ ঘটনায় নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বাদী হয়ে ৮ এপ্রিল সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন। নুসরাত হত্যা মামলায় ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে গত ২৯ মে ৮০৮ পৃষ্ঠার একটি অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন—পিবিআই। তদন্তে প্রকাশ, মেয়েকে যৌন হয়রানির অভিযোগে ওই মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী থানায় মামলা দায়ের করেন নুসরাতের মা শিরিন আক্তার। মামলায় অধ্যক্ষকে গ্রেপ্ততার করে পুলিশ। মামলা তুলে নিতে বিভিন্নভাবে নুসরাতের পরিবারকে হুমকি দেওয়া হয়। মামলা তুলে না নেওয়ায় নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার পরিকল্পনা করা হয় মাদরাসা প্রাঙ্গণেই। আসামি শাহাদাত নুসরাতকে বারবার প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু নুসরাত তা গ্রহণ না করায় শাহাদাতও হত্যার পরিকল্পনায় যুক্ত হয়। ১৬ জন আসামির মধ্যে ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। ৩০ মে মামলাটি ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। ১০ জুন আদালত মামলাটি আমলে নিলে শুনানি শুরু হয়। ২০ জুন অভিযুক্ত ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন বিচারিক আদালত। গত ২৭ জুন মামলার বাদী ও নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমানের জবানবন্দি ও জেরার মধ্য দিয়ে এই মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। এই মামলার মোট ৯২ জন সাক্ষীর মধ্যে ৮৮ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন আদালত। এ মামলার বিচার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য মাত্র ৪০ কার্যদিবসে আদালত ৮৮ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তি-তর্ক শেষে গতকাল ২৪ অক্টোবর মামলার রায় ঘোষণা করেন। ফেনীর সোনাগাজীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় ১৬ আসামির সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত।

বাংলাদেশের বিচারিক ইতিহাসে নিয়মিত আদালতে যেসব মামলার দ্রুততার সঙ্গে বিচার হয়েছে, নুসরাত হত্যা মামলার বিচার তার মধ্যে অন্যতম। কত হত্যাকাণ্ডই তো প্রতিনিয়িত সংঘটিত হয়, নুসরাতের নৃশংস হত্যাকাণ্ড নানা কারণে আলোচনায় আসে। যৌন হয়রানির শিকার একটি মেয়ে যখন বিচার চাইতে যায়, সেখানেও তাকে নানা ধরনের হয়রানির মুখে পড়তে হয়। বিচারে দীর্ঘসূত্রতা, মেয়েটিকে সামাজিকভাবে হেনস্তা করা, তদন্ত ঠিকমতো না করা বা সদিচ্ছার অভাব, প্রভাবশালীদের ক্ষমতার অপব্যবহার বা বিচারপ্রার্থীর আর্থিক সক্ষমতার অভাব, তদবির ও নজরদারির অভাব ইত্যাদির কারণে অনেকেই বিচারের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ফলে এ ধরনের অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। সে আবার অপরাধ করে। আর শাস্তি না হওয়ায় অন্যরা এ ধরনের অপরাধ করতে ভয় পায় না; বরং উৎসাহী হয়ে ওঠে। নুসরাত হত্যার সঙ্গে মাদরাসার অধ্যক্ষ, নুসরাতের সহপাঠী শিক্ষার্থী, সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিকরা সংশ্লিষ্ট ছিল। এ ছাড়া নুসরাত হত্যার ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে ওসি মোয়াজ্জেম ও দুই এসআই ইউসুফ ও ইকবালকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। বর্তমানে ওসি মোয়াজ্জেম জেলহাজতে। দায়িত্বে অবহেলায় সে সময়ে কর্মরত সংশ্লিষ্ট এসপিকেও প্রত্যাহার করা হয়েছে। নুসরাত হত্যার বিচারে প্রমাণ হয়েছে, আসামিরা যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, বিচারক, আইনজীবী, পুলিশসহ সংশ্লিষ্টরা চাইলে যেকোনো মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি সম্ভব। নুসরাত হত্যাকাণ্ডের পর থেকে মামলার দ্রুত বিচারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ধারাবাহিক বিশেষ নজরদারি ছিল। এ জন্য তাঁকেও বিশেষ ধন্যবাদ জানাতে হয়।

আসামিপক্ষ এ মামলার রায়কে চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে আপিল করবে বলে জানিয়েছে। জনমনের প্রত্যাশা, উচ্চ আদালতও দ্রুততার সঙ্গে মামলার নিষ্পত্তি করে দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করবেন। সোনার কন্যা নুসরাতের সম্মানহানি ও হত্যার যথাযথ বিচার দৃশ্যমান করে বিচারক সোনালি অধ্যায়ে নতুন দৃষ্টান্ত যোগ করবেন।

মো. জাকির হোসেন : অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ - dainik shiksha এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0067379474639893