বিজলী বাতির অভাবে রাত জেগে কুপির টিমটিমে আলোতেই লেখাপড়া। কেরসিনের অভাবে বেশিরভাগ সময়েই নিভে যেত আলো। কিন্তু নিভেনি রাজু ইসলাম। শত বাধা পেরিয়ে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় দিনাজপুর বোর্ডের অধীনে নীলফামারী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে।
তার বাবা আলম মিয়া একজন কৃষি শ্রমিক। অন্যের জমির কৃষি জমিতে শ্রম খাটানোর আয়ে জুটে না পরিবারের পাঁচ সদস্যের দুই বেলার খাবার। এর ওপর ছেলে রাজুসহ মেয়ে আসমা আক্তার ও খুশি আক্তারের লেখাড়ার খরচ বহন করা কীভাবে সম্ভব! সে লেখাপড়া শিখে বিচিৎসক হতে চায়। কিন্তু অন্তরায় এখন পরিবারের দারিদ্র্যতা।
রাজু জানায়, পেট পুরে খাওয়া জুটে না তাদের পরিবারে। ছুটিতে বাবার সাথে করেছে কৃষি শ্রমিকের কাজ। স্কুলে যেতে হয়েছিল একমুঠো পান্তা খেয়ে। সেটিও জোটেনি প্রতিদিন। শুধুমাত্র স্কুলের টিফিনের ওপর ভর করে প্রচণ্ড ক্ষুধার যন্ত্রণায়ও পড়াশুনার হাল ছাড়েনি সে।
পঞ্চম শ্রেণিতে জিপিএ-৫ পেয়ে সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পায় সে। ওই ফলাফল লেখাপড়ার প্রতি উৎসাহ জোগায় তার। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ পায় বাড়ি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দুরে সুনামধন্য নীলফামারী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। জেএসসি পরীক্ষায়ও জিপিএ-৫ অর্জন করে সাধারণ বৃত্তি পায়। তার এমন মেধায় শিক্ষকদের প্রিয় হয়ে উঠে সে।
রাজু বলে, ‘বাড়িতে বিজলির বাতির আলো নেই। রাত জেগে কুপির আলোতেই পড়তে হয়েছে। তাও নিজের ক্লান্তির আগেই ফুরিয়ে যেতো কুপির কেরোসিন। ফলে দিনের আলোতেই পড়া শেষ করতে হয়েছে বেশির ভাগ সময়ে।’
রাজু আরও বলে, ‘একটি মাত্র স্কুল ড্রেস দিয়ে আমাকে পার করতে হয়েছে এসএসসির গণ্ডি। ভালো ফলাফলের জন্য বন্ধুরা বিভিন্ন বিষয়ের নতুন বই কিনলেও আমি বই সংগ্রহ করেছি পুরাতন বইয়ের দোকান থেকে। বিদ্যালয়ে যাতায়াত করেছি পুরাতন বাইসাইকেলে। স্যারেরা স্কুলে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন বিনা বেতনে। পারিশ্রমিক ছাড়াই পড়িয়েছেন প্রাইভেট। সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।’
রাজু ইসলামের বাড়ি নীলফামারী জেলা সদরের কুন্দপুকুর ইউনিয়নের দেবীরডাঙ্গা মুন্সিপাড়া গ্রামে। পরিবারের এক ভাই দুই বোনের মধ্যে মেজ সে। বড়বোন আসমা আক্তার এবারে মানবিক বিভাগে পাশ করেছে এসএসসি। ছোট বোন খুশি আক্তার পড়ছে সপ্তম শ্রেণিতে।
রাজুর মা আঞ্জুয়ারা বেগম বলেন, ‘বাড়ির ভিটার চার শতক জমি ছাড়া আর কিছু নেই আমাদের। তার বাবার কৃষি শ্রমিকের আয়ে ছেলের লেখাপড়ার সাধ পুরণ করবো কীভাবে।’
নীলফামারী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক বিপ্লব কুমার দাস বলেন, ‘রাজু অত্যন্ত মেধাবী। একই শার্ট-প্যান্ট পরে তাকে প্রতিদিন স্কুলে আসতে দেখেছি। মাঝে মধ্যে তার পড়নে ভেজা কাপড়ও পরিলক্ষিত হয়েছে, এরপরও দমেনি সে। সহযোগিতা পেলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে অবশ্যই পৌঁছতে পারবে।’
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গোলাম রব্বানী বলেন, “আমরা সহযোগিতা করে তাকে পার করেছি বিদ্যালয়ের গণ্ডি। আরও সহযোগিতা পেলে পৌঁছতে পারবে তার লক্ষ্যে”।