‘বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানের শাখা ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার পরিচালনা বিধিমালা-২০১৪’ প্রণয়ন করা হয়েছিল পাঁচ বছর আগে। কিন্তু নানা গোঁজামিল দিয়ে নামসর্বস্ব কিছু স্টাডি সেন্টারের পক্ষে ওই বিধিমালা প্রণয়ন করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। এমনও অভিযোগ ওঠে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ওই বিধিমালার খসড়া মূলত তৈরি হয় রাজধানীর এক শিক্ষা ব্যবসায়ীর কার্যালয়ে। ওই অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হওয়ায় বিধিমালাটি সে বছরই স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর গত বছরের মাঝামাঝি আবার এই বিধিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এরই মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে খসড়াটি জমা দিয়েছে ইউজিসি। শনিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন শরীফুল আলম সুমন।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, গত ৯ জানুয়ারি ইউজিসির সদস্য ও বিধিমালা সংশোধন কমিটির আহ্বায়ক প্রফেসর ড. মো. আখতার হোসেনের সই করা সংশোধিত বিধিমালার খসড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। তবে এবার খসড়া থেকে স্টাডি সেন্টার করার বিধান পুরোপুরি বাদ দেয়া হয়েছে। সংশোধিত এই বিধিমালা পাস হলে বাংলাদেশে চালু থাকা সব স্টাডি সেন্টার অবৈধ বলে গণ্য হবে। শুধু বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস স্থাপন করা যাবে দেশে। তবে এর জন্য রাখা হয়েছে কঠোর শর্ত। ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ে ৫০০-এর ওপরে থাকা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা স্থাপন করা যাবে না বলেও শর্ত দেয়া হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) আবদুল্লাহ আল হাসান চৌধুরী বলেন, ‘সংশোধনী আমাদের কাছে এসেছে। এই বিধিমালার ব্যাপারে আইনি মতামতের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। এরপর সব প্রক্রিয়া শেষে তা জারি করা হবে। আমরা দ্রুততম সময়েই কাজ শেষ করার চেষ্টা করছি।’
বিধিমালার খসড়ায় বলা হয়েছে, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস হবে অনেকটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে ৯ সদস্যের বোর্ড অব ট্রাস্টিজ, সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল, অনুষদ, পাঠক্রম কমিটি, অর্থ কমিটি, শিক্ষক নিয়োগ কমিটি ও শৃঙ্খলা কমিটি থাকবে। এ ছাড়া কর্মকর্তাও থাকবেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো। আর বাংলাদেশে শাখা ক্যাম্পাসে প্রধান হবেন উপ-উপাচার্য বা ভাইস প্রেসিডেন্ট। এ ছাড়া ট্রেজারার, ডিন, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, রেজিস্ট্রার, প্রক্টর, বিভাগীয় প্রধান, ছাত্রকল্যাণ উপদেষ্টা, পরিচালক (অর্থ), জনসংযোগ কর্মকর্তা ও লাইব্রেরিয়ান থাকবেন। বোর্ড অব ট্রাস্টিজের কোনো সদস্য ভারপ্রাপ্ত হিসেবেও উপ-উপাচার্য বা ভাইস প্রেসিডেন্ট বা ট্রেজারার থাকতে পারবেন না।
খসড়া বিধিমালা অনুযায়ী, শাখা ক্যাম্পাসকেও সমাবর্তন করতে হবে। তবে সনদপত্রে সই করতে হবে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উপাচার্য বা প্রেসিডেন্টকে। এমনকি সমাবর্তনের সময় তাঁকে উপস্থিত থাকতে হবে। কোনো শাখা ক্যাম্পাস বিধিমালা না মানলে প্রত্যেকবার ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড করা যাবে। এ ছাড়া কোনো শাখা ক্যাম্পাস বন্ধ হলে বা কোনো কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের কারণে শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা কোনো শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী ক্ষতিগ্রস্ত হলে শাখা ক্যাম্পাস কর্তৃপক্ষকে সংশ্লিষ্টদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
জানা যায়, দেশে বর্তমানে শতাধিক স্টাডি সেন্টার পরিচালনা করা হচ্ছে। ইউজিসি থেকে বারবার ওই সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার নির্দেশ দেয়া হলেও তারা তা মানছে না। এমনকি কয়েক বছর আগে ৫৬টি স্টাডি সেন্টার বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিল ইউজিসি। সংশোধিত বিধিমালা জারি হওয়ার পর অনুমোদনহীন অবস্থায় চলা ওই সব স্টাডি সেন্টার আইনগতভাবেই নিষিদ্ধ হবে।
এ ছাড়া দেশে এখন অর্ধশত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালু আছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১০ থেকে ১৫টি ছাড়া বাকিগুলো মানহীন। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে পড়ালেখা ছাড়াই সার্টিফিকেট পাওয়া যায়। এ অবস্থায় দেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসম্মত শাখা ক্যাম্পাস চালু হলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হবে। এতে উচ্চশিক্ষার মান বাড়বে। তবে যদি বিধিমালা পাস হওয়ার সময় ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ে ৫০০-এর মধ্যে থাকার বাধ্যবাধকতা তুলে দেয়া হয়, তাহলে অখ্যাত বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট বিক্রির দ্বার নতুনভাবে উন্মোচিত হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, ‘যেসব বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় ওয়ার্ল্ড র্যাকিংয়ে আছে, তারা এলে প্রতিযোগিতা বাড়বে। যাদের কোয়ালিটি, টিচিং, রিচার্সসহ সব কিছুই উন্নতমানের, তারা এ দেশে এলে ক্ষতি নেই। মালয়েশিয়ায় অনেক বড় বড় বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস আছে, সেখানে তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তবে প্রফিট মার্জিন কী হবে, ফি সহনশীল থাকছে কি না সেটা বিধিমালায় থাকতে হবে। আর আমাদের দেশে যেহেতু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অনেক, তাই তারাও যাতে ক্ষতির মুখে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।’