শিক্ষক ও শিক্ষার উন্নয়নে দশ সুপারিশ - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষক ও শিক্ষার উন্নয়নে দশ সুপারিশ

মো. মিজানুর রহমান মজুমদার |
আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবসে মনে আসছে কোভিড-১৯ সংকট মোকাবেলায় সময়মতো সঠিক উদ্যোগ নেয়া জরুরি। অনলাইন শিক্ষা, দূর্বল জনগোষ্ঠীকে সহায়তা, প্রতিষ্ঠান পুন:চালুকরণ এবং শিক্ষাক্ষেত্রে যে দীর্ঘ গ্যাপ তৈরি হয়েছে তা কমাতে শিক্ষক নেতৃত্বকে ভূমিকা রাখতে হবে।
 
বর্তমান প্রেক্ষাপটে যারা বিশ্বের শিক্ষা ক্ষেত্রে যে পশ্চাৎপদতার সৃষ্টি হয়েছে সেটা মোকাবেলা করা কঠিন হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। আমাদের দেশেও প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা দারুনভাবে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। গত ১৭ মার্চ থেকে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকগন দুঃশ্চিন্তার মধ্যে আছেন। ছাত্র/ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সকলে চিন্তিত। সরকার শিক্ষা কার্যক্রমকে সচল রাখতে ইতিমধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহন করে আসছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে রাখতে প্রশাসনসহ স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষিও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সার্বক্ষনিক মনিটরিং করছেন। বিশেষ করে জীবন ও জীবিকার কথা বিবেচনা করে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করার নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। সবাইকে স্বাস্থ্য বিধি মেনে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার আহবান জানিয়েছেন। সব কিছু বিবেচনা করে বিশেষ করে ছাত্র-ছাত্রীরা যাতে করে কোন ভাবেই করোনা আক্রান্ত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার নির্দেশনা জারি করেছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে পক্ষে বিপক্ষে অনেকে যুক্তি উপস্থাপন করলেও মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী বারবার বলছেন কোনভাবেই আমরা একজন শিক্ষার্থীকেও করোনা আক্রান্ত হতে দিতে পারি না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পর শিক্ষার্থীরা আক্রান্ত হওয়ার পর পুনরায় তা বন্ধ ঘোষনা করতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সাতে বিবেচনা করে অদ্যাবধি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে। ফলে আমাদের শিক্ষার্থীরা এই মহামারিতে খুব বেশী আক্রান্ত হয়নি। সরকারের এই সিদ্ধান্তকে আমরা সাধুবাদ জানাই।
 
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার ফলে তাদের পাঠক্রম যাতে ব্যাহত না হয় সেজন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন ক্লাসও চালুর নির্দেশনা প্রদান করে। সে অনুযায়ী সকল স্তরে অনলাইন ক্লাস চালু করা হয়। সেক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম সমস্যা যেমন স্মার্ট ফোন, ইন্টারনেট এর অপ্রতুলতার কারনে ছাত্র/ছাত্রীদের ক্লাস করতে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। ইতিমধ্যে করোনার কথা বিবেচনা করে পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষা বন্ধ ঘোষনা করা হয়েছে। অষ্টম শ্রেনী থেকে নবম শ্রেনী উত্তীর্নের জন্য স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান তাদের ছাত্র/ছাত্রীদের মূল্যায়ন করে ব্যবস্থা গ্রহন করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সব কিছু বিবেচনায় রেখে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আগামী ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
 
আগামী অক্টোবর/নভেম্বর এর মধ্যে কোন কারনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব না হলে শিক্ষাবর্ষ আগামী ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত বাড়িয়ে নেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। গত এপ্রিল মাস থেকে এইচ.এস.সি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও করোনার কারনে অদ্যবদি নেয়া সম্ভব  হয় নি। ফলে এইচ এসসি পরীক্ষা নেয়া জরুরী হয়ে পড়েছে।  কারন এইচ এসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে ছাত্র/ছাত্রীরা পরবর্তীতে মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে ভর্তির সুযোগ পায়। এপ্রেক্ষাপট এ করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সাথে সাথে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা নেয়ার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।
 
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্র/ছাত্রীদের অনলাইন ক্লাস ও সংসদ টিভির মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এতে ছাত্র/ছাত্রীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা, এ্যাসাইনমেন্ট তৈরী করাসহ পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে।
 
বাস্তবতা হলো এ ধরনের পরিস্থিতির জন্য আমরা কখনও প্রস্তুত ছিলাম না। হঠাৎ করে সারা বিশ্বে যখন করোনা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়লো তখন থেকে অন্যান্য দেশের মতে বাংলাদেশেও সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শিক্ষা স্থবির হয়ে পড়ে। আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্বেও এসব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে। বিশেষ করে সকল পর্যায়ের শিক্ষাকদের প্রস্তুতি, তাদের অনলাইন ক্লাসের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, ইন্টারনেট এর অপ্রতুলতাসহ নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এছাড়াও ছাত্র/ছাত্রীদের অনাগ্রহ ও তাদের সুযোগ সুবিধা না থাকায় ক্লাস এ অংশগ্রহন মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক এ ৫০ শতাংশের মত ছাত্র/ছাত্রী ক্লাস-এ অংশগ্রহন করলেও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এর হার ৩০ শতাংশের কম।
২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে শিক্ষায় বাজেট ছিল ১১ দশমিক ৬৮ শতাংশ ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে যা ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ প্রত্যাশা ছিল সরকার কোভিড-১৯ মোকাবেলায় অন্তত ১৫ শতাংশ বরাদ্দ রাখবে। সরকার অনেক সেক্টরকে প্রনোদনা প্রদান করেছেন। শিক্ষকরা প্রনোদনা চায় না। তাদের মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে।
 
ইউনেস্কো এবং গ্লোবাল ফান্ডিয়ের আওতায় সরকার আগামী ২০২১-২০২৫ সালের জন্য একটি দীর্ঘ মেয়াদী শিক্ষাখত পরিকল্পনা বা ইএসপি বাস্তবায়নের জন্য ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। উক্ত পরিকল্পনায় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে প্রাথমিক, প্রাক-প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কারিগরি, মাদ্রাসা ও উচ্চ শিক্ষাসহ সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাকে একটি সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থা গ্রহন করার মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে বলে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকলে মনে করেন।
 ইউনেস্কো বলছে এখনই সতর্ক না হলে শিক্ষা পিছিয়ে পড়বে। ২০৩০ সালের এসডিজি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। ইতিমধ্যে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
 
করোনা পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হলে এখনই বাস্তব সম্মত পরিকল্পনা গ্রহন করে তা বাস্তবায়নের সঠিক পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে।
 
সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবেলা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই নিউনরম্যাল এর বাস্তবতা বিবেচনা করে শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে এগিয়ে আসতে হবে। এজন্য সরকারকে নীতি নির্ধারনসহ সকল প্রকার পরিস্থিতি মোকাবেলায় শিক্ষক, অভিভাবক, এনজিও, সুশীল সমাজ ও জনপ্রতিনিধিসহ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকলের মতামত নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে হবে। বিশেষ করে শিক্ষক সংগঠনের প্রতিনিধির সাথে আলোচনা করে মাঠ পর্যায়ের সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করতে সরকারের নিকট আকুল আবেদন জানাচ্ছি। কারন যে কোন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষকদের সরাসরি অংশগ্রহন ছাড়া সম্ভব নয়। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস মুজিববর্ষে দেশরত্ম বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষানীতি ২০১০ এর বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে পর্যায়ক্রমে “শিক্ষা ব্যবস্থার জাতীয়করন” এর ঘোষনার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। বিজ্ঞান ভিত্তিক আধুনিক ও বিশ্বমানের শিক্ষা ব্যবস্থা  প্রবর্তন করা সম্ভব হবে। 
 
বর্তমান প্রেক্ষাপটে কোভিড-১৯ মোকাবেলা ও এসডিজি-৪ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দশটি প্রস্তাবনা পেশ করছি।
 
১. ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষা খাতে জিডিপি’র ৬শতাংশ এবং বাজেটের ২০শতাংশ বরাদ্দ রাখার সুপারিশ করছি।
২. সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ন্যায় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের পুর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা, বাংলা নববর্ষ ভাতা বাড়ী ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা প্রদান।
৩. সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন ভাতা, পদান্নতিসহ সকল বৈষম্য দূরীকরণ।
৪. বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে অনুপাত প্রথা বিলুপ্ত করে সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদে পদোন্নতি প্রদান।
৫. ২০২১-২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের ইএসপি বাস্তবায়নে সরকারি-বেসরকারি বৈষম্য দূর করে সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহন।
৬. নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং অনার্স ও মাস্টার্স কোর্সে পাঠদানকারী শিক্ষকসহ বিধি মোতাবেক নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষক কর্মচারীদের এমপিও ভুক্তকরণ।
৭. জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০১০ যথাযথ  যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে পর্যায়ক্রমে “শিক্ষা ব্যবস্থার জাতীয় করন”।
৮. অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে যেতে ইন্টারনেট সুবিধা বৃদ্ধি ও স্বল্পমূল্যে ডাটা ব্যবহারের সুবিধা।
৯. শিক্ষকদের মানসম্মত শিক্ষাদান নিশ্চিত করতে তাদের প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা গ্রহন।
১০. ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠান-এ ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ গ্রহন।
 
লেখক: মো. মিজানুর রহমান মজুমদার, সহযোগী অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, সিদ্দেশ্বরী কলেজ, ঢাকা
 
যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি
হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0079798698425293