‘শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার, দিল্লীর পতি সে কোন্ ছার’ শিশুতোষ সাহিত্যে খ্যাতনামা কবি কাজী কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতার মধ্য ভাগের এই পঙক্তি আজ অনেকের কাছে অপরিচিত। ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবসে দেশের শিক্ষা বিষয়ক সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং গ্রহণযোগ্য অনলাইন পত্রিকা ‘দৈনিক শিক্ষাডটকম’ পত্রিকা গতকাল থেকেই কবিতার এই পঙক্তি শিক্ষক সমাজকে শ্রদ্ধা জানায়। পত্রিকাটির ফেসবুক পেজেও শেয়ার করে তা। আমিও সেখান থেকে পঙক্তিটি কপি করে নিজের ফেসবুকে শেয়ার করি। তবে দুঃখের বিষয় ওই স্ট্যাটাস শেয়ার করার পর আমাকে বেশ ক’জন ফোন করেন। জানতে চান ‘দিল্লীর পতি সে কোন্ ছার’ এর মানে কী? আমার জানাতে হয় কবিতা, বোঝাতে হয় কবিতার বিষয়বস্তু। এই আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষকদের মর্যাদার অবস্থা। হয়তো মর্যাদার প্রশ্নে বর্তমান সময়ের শিক্ষকদের আচরণকেই দায়ী করবেন অনেকে। সে ব্যাপারে বলার আগে কবি কাজী কাদের নেওয়াজ সম্পর্কে একটু জানিয়ে রাখছি।
আরও দেখুন: বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপন শুরু হলো যেভাবে (ভিডিও)
কাজী কাদের নেওয়াজ ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ জানুয়ারি মুর্শিদাবাদ জেলার মাতুলায়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মাখরুন উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে এন্ট্রান্স এবং বহরমপুর কলেজ থেকে ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজিতে অনার্স পাস করেন। তিনি প্রেম ও পল্লীর শ্যামল প্রকৃতি কবি হলেও শিশুতোষ সাহিত্যে ছিলেন সবচেয়ে খ্যাতিমান। ‘মরাল’ তার সমাদৃত কাব্যগ্রন্থ। শিশুরঞ্জক গদ্য ‘দাদুর বৈঠক’ কাব্যগ্রন্থ ‘নীল কুমুদী’ এবং ‘দুটি তীরে’ নামে একটি উপন্যাসও রয়েছে তাঁর। পৈতৃক নিবাস বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট গ্রামে হলেও দেশ ভাগের পরে তিনি পশ্চিমবঙ্গ ত্যাগ করে ঢাকায় আসেন এবং নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দেন। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে দিনাজপুর জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে চাকরি জীবনের অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং প্রেসিডেন্ট পুরস্কার পান। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩ জানুয়ারি এই শিক্ষক কবি বাংলার শ্যামল প্রকৃতি ছেড়ে শেষ বিদায় নেন। তবে রেখে যান তাঁর সু-সাহিত্যকর্ম আর শিক্ষাকতা জীবনের আদর্শ।
পাঠকের ধৈর্য্যচ্যুতি না করে এবার সংক্ষেপে কথা শেষ করছি। দেশের রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে বর্তমান সমাজে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, যার কোনো শিক্ষক নেই। আমি মানছি বর্তমান সময়ে কতিপয় শিক্ষকের আচরণ দেশের শিক্ষক সমাজকেই কিছুটা বিতর্কিত করছে। তবে, সবাই এক নয়। এখনও সমাজে ভালো শিক্ষক রয়েছেন। বাবা-মা সন্তান জন্ম দিয়ে থাকলেও প্রকৃতপক্ষে মানুষ হিসেবে মানুষকে জন্ম দেন একজন সু-শিক্ষক। তাই একটি দেশের শিক্ষা ও শিক্ষক সমাজকে সার্থক ও মর্যাদাপূর্ণ করা রাষ্ট্রের প্রধান কর্তব্য। দুটোর কোনোটাই তার মর্যাদা হারালে সে দ্বায়ভার সর্বপ্রথম রাষ্ট্রকেই বহন করতে হয়। তাই বিতর্ক কিংবা ব্যর্থতা থাকলেও রাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হবে সমস্যা কিংবা সংকট সমাধানে।
আজ ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস বিভিন্ন দেশে পালন করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয়ভাবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, যেখানে আমাদের দেশে নানা দিবস ঘটা করে পালন করা হয়, সেখানে শিক্ষক দিবসে রাষ্ট্রীয় কোনো আয়োজন নেই। শিক্ষকদের অবদানকে স্মরণ করার জন্য ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’। এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের মূল প্রতিপাদ্য ‘তরুণরাই এই পেশার ভবিষ্যৎ’। ইউনেস্কোর মতে, বিশ্ব শিক্ষক দিবস হচ্ছে শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি। আমাদের বাংলাদেশেও সে উপলব্ধি থেকে, দায়বদ্ধতা থেকে, চেতনা থেকে এবং সর্বোপরি শিক্ষা ও শিক্ষকের মর্যাদায় বিশ্ব শিক্ষক দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করবে, সেটাই বিশ্ব শিক্ষক দিবসে এ ক্ষুদ্র লেখকের একান্ত কামনা।
পলাশ রায় : সাংবাদিক ও শিশু সংগঠক।