ঝিনাইদহে ‘ছাত্র ইংরেজি না পারায় শিক্ষক বরখাস্ত’র ঘটনাটি সারাদেশে শিক্ষকদের মাঝে আলোড়ন তুলেছে। যদিও আজকে দৈনিকশিক্ষা ডটকমের খবরে জানতে পেরেছি ‘সেই শিক্ষকের বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার’ করা হয়েছে। তবে শিক্ষক বরখাস্তের ঘটনা শুধু একটি ঘটনা-ই নয়; প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার জন্য অশনি সংকেত এবং একটি শিক্ষাও বটে। এ অবস্থা থেকে এখনই যদি উত্তরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয়, তবে প্রাথমিক শিক্ষা হুমকির মুখে পড়বে।
ঘটনাটি বিশ্লেষণ করলে প্রথমেই আসবে- ওই শিক্ষক আইসিটিতে প্রশিক্ষিত হয়েও শ্রেণিকক্ষে তা বাস্তবায়ন করেন না। উক্ত শিক্ষক তথা সারাদেশের বেশিরভাগ (সবাই নন) শিক্ষকই শুধু আইসিটি ট্রেইনিং-ই নয়; বিষয়ভিত্তিক ট্রেইনিংসহ আরও অনেক রকম প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকেন। কিন্তু তারা তা বাস্তবায়ন করছেন না বা করতে পারছেন না। কেন পারছেন না? কোথায় তাদের সমস্যা, কোথায় প্রতিবন্ধকতা তা অবশ্যই কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় আনা উচিৎ। এবং তা প্রতিবিধান করাও প্রয়োজন। কিন্তু তেমন কোনো পদক্ষেপ কি কেউ নিচ্ছে?
এরপর আসি শিক্ষার্থীর কথায়। তারা সাবলীলভাবে রিডিং পারে না। ইংরেজি তো অনেক দূরের ব্যাপার, প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রাথমিকের অনেক শিক্ষার্থী বাংলা-ই ঠিকমতো পড়তে পারে না। এ ছাড়া সরকার অনেক রকম প্রকল্প চালু করছে। মিড-ডে-মিল, উপবৃত্তি ইত্যাদি। তবুও কেন শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়মুখী নয়, তার কারণও খুঁজে বের করা দরকার। গাণিতিকভাবে আমরা সবাই বলি ঝরেপড়া নেই। আবার আমরাই ফেসবুকে পথশিশুদের নিয়ে পাঠশালা খোলা যুবক বা লোকটাকে সাধুবাদ দেই। ঝরেপড়া যদি না-ই থাকে তবে ঐ লোকটা ঐসব শিশু কোথায় পেল? কাগজ-কলম রেখে একটু বাস্তবতায় আসা উচিৎ।
এবার আসা যাক, স্কুল পরিদর্শনের বিষয়ে। কখনো কখনো পরিদর্শনকারী কর্মকর্তা এমনভাবে পুলিশি পরিদর্শন করেন যে, শিক্ষক নিজেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান। শিশু-তো নস্যি। আবার কোনো শিক্ষককে কেউ একজন, হোক সে এলাকার কেউ বা পরিদর্শনকারী কর্মকর্তা, যদি ধমকের সঙ্গে বা উচ্চস্বরে কথা বলেন এবং কোনো শিক্ষার্থী যদি তা দেখে বা শুনে বা বুঝতে পারে, তবে তা সরাসরি তার ওপর এফেক্ট করে। তখন তার ভয় পাওয়াটা হয়ে যায় স্বাভাবিক। ঐ সময় পাঠ পারা শিশুটিও হয়ে পড়ে আতঙ্কগ্রস্ত এবং অপারগ। একটা শিশু যখন দেখে তার শিক্ষককে ধমক দেয়া হচ্ছে, তখন ঐ শিশুর কী অবস্থা হয় তা সহজেই অনুমেয়। এসবের প্রতিকারের জন্যও ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ।
এবার আসি কর্মকর্তার কথায়। বেশিরভাগ কর্মকর্তা শুধু অর্ডার দিতেই ভালোবাসেন (শুধু প্রাথমিক ডিপার্টমেন্টে নয়, প্রায় সব ডিপার্টমেন্টেই)। তারা মনে করেন তারা আমাদের (শিক্ষকদের) কর্তা, তারা বেতন না দিলে আমরা খেতে পারব না, চলতে পারব না। তারা পরামর্শক না হয়ে হুকুম দিতেই বেশি পছন্দ করেন।
পৃথিবীতে কেউই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়; সবারই অপূর্ণতা রয়েছে। তাহলে ভুলটা সংশোধন করে দেয়াটাই কি উচিৎ নয়? যেখানে বলাই আছে- একবার না পারিল দেখ শতবার। আসলে তাদেরই-বা দোষ কোথায়? দোষ তো সিস্টেমে। সচিব/ উপসচিব/ মন্ত্রী/ উপমন্ত্রী মহোদয় বলেছেন করতে হবে, সুতরাং করতে হবে। কীভাবে করবে, কেন করবে, ফলাফল কী হবে, সেটা বোঝার চেষ্টাই কারো মধ্যে নেই। সবার ভাব শুধু করতে হবে।
প্রাথমিক শিক্ষার একটি লক্ষ্য, তেরোটি উদ্দেশ্য, আর ঊনত্রিশটি প্রান্তিক যোগ্যতার আলোকে শিক্ষাক্রম প্রণীত হয়। তাহলে সময়ে সময়ে আবার পরিপত্র দিয়ে এটা করতে হবে সেটা করতে হবে, এসব কেন করা হয়? তাহলে শিক্ষাক্রম কি অপূর্ণ? আমরা জানি শিক্ষাক্রম যুগের সঙ্গে পরিবর্তনশীল। কিন্তু তার জন্য সময় তো লাগবে। প্রতি বছর দু’চার বার করে পরিবর্তন করলে সেটাকে কি শিক্ষাক্রম বলা যাবে?
এবার আসি কর্মকর্তার বানান ভুলের ব্যাপারে। অনেকেই জানেন না যে, (প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানেন) প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর যোগ্যতা যাচাই করা হয়। যে প্রশ্নের মাধ্যমে যে যোগ্যতা যাচাই করতে চাওয়া হয়, সেখানে যদি বানানের যোগ্যতা না থাকে, তাহলে উক্ত প্রশ্নের উত্তরের বানানের জন্য কোনোরূপ নম্বর কাটা যায় না। যেমন বাংলাদেশের রাজধানীর নাম কী? এ প্রশ্নে হয়তো শিক্ষার্থী রাজধানীর নাম জানে কিনা সে যোগ্যতা যাচাই করতে চাওয়া হচ্ছে? এখন উত্তরে যদি সে শুধু ‘ঢাকা’ লেখে তাহলেও পূর্ণ নম্বর পাবে। আবার যদি পুরো একটা বাক্য লিখতে গিয়ে সব বানান ভুল করেও শুধু ঢাকা বানান ঠিক থাকে তাহলেও সে পূর্ণ নম্বর পাবে। আগের যে বানানগুলো ভুল হলো তা আমরা গণ্যই করলাম না। এতে করে কি হচ্ছে? তার কিন্তু বানানের যোগ্যতার ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। এ শিক্ষার্থীই যদি কখনো কোনো দপ্তরের কর্মকর্তা হয়, তখন তার কাছ থেকে আপনি কেমন বানান আশা করতে পারেন।
উপরিউক্ত ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রাথমিক শিক্ষাকে এখনই যদি ঢেলে সাজানো না হয়, তাহলে জাতির সামনে ভবিষ্যৎ অন্ধকার-ই থেকে যাবে। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা শিক্ষা বলে চিৎকার-ই করব। ফলাফল আরও খারাপ হয়ে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ঘটা অস্বাভাবিক নয়।
লেখক: শিক্ষক।