শিক্ষক সমাজ নিয়ে অধ্যাপক মোজাফফরের ভাবনা - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষক সমাজ নিয়ে অধ্যাপক মোজাফফরের ভাবনা

মো. সিদ্দিকুর রহমান |

গরীব-মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্রত নিয়ে শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে রাজনীতিতে এসেছিলেন প্রয়াত নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। রাষ্ট্রভাষাসহ আইউব খানের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। সে সময় মস্কো সফরে গিয়ে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অর্থ প্রদান ও সামরিক সমর্থন আদায়ে সফল হন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মাধ্যমে, ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনী গঠন করে কয়েক হাজার সদস্যকে সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা তাঁর অন্যতম সাফল্য। স্বীয় আদর্শে অবিচল থেকে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণ করে তিনি বঙ্গবন্ধুসহ আপামর জনতার কাছে সম্মানিত ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ইউনিয়নের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে চাঁদপুর কলেজ থেকে তাঁরই আদর্শের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। চাঁদপুর কলেজের প্রফেসর আবদুস সাত্তার ও শিক্ষক জীবন কানাইয়ের সংস্পর্শে এসে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হই। ঢাকাতে প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের পর মাঝে মাঝে নিউমার্কেটের হকার্স মার্কেট অফিসে আসা-যাওয়া হতো।

স্বাধীনতার পর আমার প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু হয় তখনকার বিশাল রমনা থানার (বর্তমান ১৪টি থানা) সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা মহানগরীর দপ্তর সম্পাদক হিসাবে। জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনকালে শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান। আমার এক সহকর্মী নেতা জাসদের রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকার কারণে চাকরির ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়। বিষয়টি তদবিরের জন্য তাকে নিয়ে যেতে হয়েছিল নিউমার্কেটের ন্যাপ অফিসে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের কাছে। তিনি আমাকে বললেন, তুমি ওনাকে নিয়ে আজ রাত ১০টায় আমার বাসায় এসো। আমার সহকর্মী নেতা অধ্যাপক মোজাফফর স্যারকে বললেন, আমাদের সাথে একজন মহিলা শিক্ষক থাকবেন। সন্ধ্যা ৭টায় অনুমতি দিলে সুবিধা হয়। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ তাঁর পীড়াপীড়িতে রাজি হন। উক্ত নেতাসহ আমি রাত সাড়ে ১০টায় তাঁর কাকরাইলের দোতলা বাসায় হাজির হই। স্যার আমাদের সময়ের প্রতি বিরূপ আচরণ দেখে উত্তেজিত হয়ে বললেন, আপনাদের জন্য অফিসে অনেক কাজ রেখে ৭টার পূর্বে বাসায় আসি। অথচ আপনারা সময়ের গুরুত্ব দিলেন না। শিক্ষকেরা সময়ানুবর্তী না হলে আগামী প্রজন্ম সময়জ্ঞান থেকে ছিটকে পড়বে। অপরদিকে, আপনারা হলেন সহজ-সরল প্রাথমিক শিক্ষকদের নেতা। তাদের আপনারা কী নেতৃত্ব দেবেন?

তিনি গ্রামের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন বিধায় সহজ-সরল প্রাথমিক শিক্ষক সম্পর্কে মন্তব্য করলেন, তাঁরা শিশুদের পাঠদান করান বিধায় আচার-আচরণ, চলাফেরা, কাপড়-চোপড় সবকিছুতেই প্রাথমিকের প্রভাব আছে। উক্ত শিক্ষক নেতাকে তিনি বললেন, আপনি জাসদ না নকশালের রাজনীতি করেন আমার কাছে তা মুখ্য নয়। আপনি বিপদে আছেন, বর্তমানে আপনার উপকার করা আমার ধর্ম। তিনি উক্ত নেতাকে চলে যেতে বলে, আমাকে থাকতে বললেন। তাৎক্ষণিকভাবে তখনকার শিক্ষা উপদেষ্টা ও ডিপিআই প্রয়াত আবদুল্লাহ আল মুতি শরফুদ্দীন টেলিফোন করে সমস্যার সমাধান করে দিলেন।

তিনি মানুষের চেহারা দেখে তার সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারতেন। একদিন এক ব্যবসায়ীকে নিয়ে তাঁর সামনে হাজির হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, উনি কোন পেশায় আছেন? অধ্যাপক মোজাফফরের প্রায় প্রতিটি বাক্যে ছিল রসমিশ্রিত, তীক্ষ্ম বুদ্ধি ও উদ্ভাবনী ঝলক। তিনি আমাকে উদ্দেশ করে বললেন- শিক্ষক নেতা, আমি চল্লিশ বছর দালালি করেছি। তুমিও দীর্ঘসময় দালালি করলে অভিজ্ঞতা হবে। মানুষকে ভালোভাবে জানতে পারবে। উনি কোনো অবস্থাতেই শিক্ষক নয়। টুকটাক ব্যবসা-বাণিজ্য করেন।

অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের সময়ানুবর্তিতা দেখে এবং তাঁর কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে শিক্ষকদের তথা শিক্ষার জন্য কাজ করাটা আমার জীবনে অনেকটা নেশার মতো হয়ে পড়েছে। বয়স-ক্লান্তি কিছুই পিছু টানতে না পেরে আজ দূরে সরে যেতে বসেছে।

মুক্তিযুদ্ধ তথা দেশ মাতৃকার জন্য তাঁর ভালোবাসার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের সরকার তাঁকে স্বাধীনতা পদক প্রদান করার ঘোষণা দেন। তিনি স্বানন্দচিত্তে সে পদক গ্রহণ করেন নাই। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশকে স্বাধীন করার কাজ করেছি। স্বাধীনতা প্রাপ্তিই আমার বড় পদক।

জীবনে যতবার তাঁকে দেখেছি, তাঁর রসালো কথাবার্তা, আচার-ব্যবহার, নিবেদিতভাবে মানুষের জন্য কাজ করা, সততা, আদর্শ আমাকে মুগ্ধ ও অনুপ্রাণিত করেছে। তবে প্রিয় নেতাকে স্মরণ করার পাশাপাশি এদেশে তাঁর আদর্শ জাগরিত হোক; এ আশা আজকের দিনে নিরাশা হলেও প্রত্যাশা করি। ক্ষণিকের জীবনে আমরা যেন মানুষের জন্য কিছু করি। বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষক সমাজ বঙ্গবন্ধুর কাছে ঋণী। তাঁদের এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে আগামী প্রজন্মকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে। সময়ানুবর্তিতাসহ শিক্ষাদানের কাজটি যথাযথভাবে করলে দেশমাতৃকাকে ভালোবাসার পদক ঝুলবে তাঁদের অন্তরে।

অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ স্বাধীনতার ঊষালগ্নে প্রায়ই বলতেন, আমি ৪০ বছর দালালি করছি। তাঁর এ দালালি হলো এদেশের গরীব মানুষের স্বার্থ রক্ষা, ভাষা আন্দোলনসহ স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান রাখা। অথচ শিক্ষক নেতারা, আপনারা প্রাথমিক শিক্ষকদের দুঃখ-ব্যথা ও বেদনায় শরিক না হয়ে শিক্ষা অফিসার, ডিজি, সচিব ও মন্ত্রীকে ‘জ্বি স্যার, জ্বি হুজুর’ করা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। শিক্ষক সমাজের স্বার্থ নিয়ে আপনাদের কণ্ঠ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিরব। অনুগ্রহ করে শিক্ষা ও শিক্ষকদের স্বার্থে দালালি করেন। তাতে শান্তি ও সমৃদ্ধি পাবে শিক্ষক সমাজের মন ও অধ্যাপক মোজাফফরের আত্মা। প্রিয় নেতার রূহের মাগফিরাত কামনা করি এবং শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই। তাঁর আদর্শ বাস্তবায়িত হয়ে সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে উঠুক এই আমাদের প্রত্যাশা।

মো. সিদ্দিকুর রহমান : সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ; সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিক শিক্ষাডটকম।

জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0077300071716309