শিক্ষকদের ওপর ম্যানেজিং কমিটির কর্তৃত্ব - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষকদের ওপর ম্যানেজিং কমিটির কর্তৃত্ব

আসাদুজ্জামান কাজল |

গত বৃহস্পতিবার এক বক্তব্যে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেছেন, 'ম্যানেজিং কমিটির অশিক্ষিতরা শিক্ষকদের ওপর বেশি কর্তৃত্ব ফলান।' বিষয়টি এতদিন পর আমাদের শিক্ষা উপমন্ত্রী অনুধাবন করতে পেরেছেন বলে ব্যক্তিগতভাবে খুশি।

তিনি বিষয়টি শুধু অনুধাবনই করেননি, বরং আরও বলেছেন, শিক্ষকদের সম্মান দেওয়ার মতো শিক্ষিত লোক ব্যবস্থাপনা কমিটিতে নিয়োগ দেওয়ার পাশাপাশি বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। শিক্ষা উপমন্ত্রীর বক্তব্যে আমরা আশাবাদী। বহুদিন পর আমরা একজন ভালো, উচ্চশিক্ষিত মন্ত্রী পেয়েছি এবং তার হাত ধরেই আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

ম্যানেজিং কমিটির অশিক্ষিতরা শুধু শিক্ষকদের ওপর কর্তৃত্বই ফলান না; তাদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না, যার প্রমাণ আমরা প্রায়ই গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে দেখে থাকি। আমাদের নিশ্চয় মনে আছে, মাদ্রাসার জমি দখলে বাধা দেওয়া এবং ব্যবস্থাপনা কমিটিতে জায়গা না পেয়ে গত বছরের ১১ মে বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের কাঁঠালিয়া গ্রামের মাদরাসার সুপার মো. আবু হানিফের মাথায় প্রকাশ্যে মলমূত্র ঢেলে দিয়েছিল স্থানীয় জাতীয় পার্টির নেতা জাহাঙ্গীর মৃধা ও মাসুম সরদারের লোকজন। 

এর আগে ২০১৬ সালের মে মাসে নারায়ণগঞ্জ পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে স্থানীয় সাংসদের নির্দেশে কান ধরিয়ে ওঠবস করানো হয়েছিল। ২০১৬ সালের ঘটনার সেই অর্থে কোনো বিচারই হয়নি। উল্টো, শ্যামল কান্তি ভক্তকে ঘুষের টাকা নেওয়ার অভিযোগে কারাগারে যেতে হয়েছিল। শুধু যে শ্যামল কান্তি ও আবু হানিফকেই এমন ন্যক্কারজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে তা নয়। প্রায় প্রতি মাসেই কোথাও না কোথাও এমন ঘটনা ঘটছে। কিন্তু সেগুলোর ভিডিও ফুটেজ বা সঠিক প্রমাণ না থাকায় তা সামাজিক মাধ্যম বা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে না। যেমন, গত বছরেই কুষ্টিয়ার মিরপুরে চাঁদা না দেওয়ায় প্রধান শিক্ষককে থাপ্পড় মেরেছিলেন ওই স্কুলের ব্যবস্থাপনা 

কমিটির সভাপতি। বহু ঘটনার দুই-একটা সম্পর্কে আমরা অবগত হই। বেশিরভাই চাপা পড়ে যায়। 

আমার মনে হয়, এই ব্যবস্থাপনা কমিটি বর্তমান স্কুল-কলেজের ওপর একটি বিষফোড়া। সময়ের পরিক্রমায় এই ব্যবস্থাপনা কমিটি দুটি রূপ ধারণ করেছে। আমি যখন ছোট তখন দেখতাম, গ্রামের স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতিসহ অন্যরা নিজের কাজ ফেলে সারাদিন কৃষকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধান তুলতেন, আর যাদের বাঁশবাগান আছে তাদের কাছ থেকে একটি করে বাঁশ চাইতেন স্কুলের বেড়া বা ছাউনি দেওয়ার জন্য।

আমি খুব আগ্রহ নিয়ে তাদের পিছে ঘুরতাম আর এগুলো দেখতাম। স্কুলের উন্নয়নে গ্রামের মানুষ খুব আগ্রহের সঙ্গে তাদের সহযোগিতা করত। সঙ্গে আশীর্বাদও থাকত এমন সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে। সময়ের পরিক্রমায় সেই স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটি আর আগের জায়গায় নেই। গ্রামের যারা মাতব্বর তারাই এখন স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে জায়গা করে নেয়।

খুঁজলে হাজার হাজার প্রমাণ মিলবে, নিজে তার নামটি পর্যন্ত স্বাক্ষর করতে পারে না, অথচ স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য। কারণ, সে স্থানীয় পর্যায়ে আর্থিক অথবা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। বর্তমানে ব্যবস্থাপনা কমিটির পদগুলো খুবই লোভনীয়। আগে আরও বেশি ছিল! তবে সেটা সম্মান নয়; টাকা কামানোর জন্য। আগে তারা শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিতে পারত। এখন শুধু কর্মচারী ও প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারে।

এ জন্য অবশ্য সরকারের প্রতি তারা প্রচণ্ড বিরক্ত। কেননা, সরকার তাদের বিনা পুঁজির ব্যবসায় লাগাম টেনেছে। এমনকি সরকার যেন এই সিদ্ধান্ত না নেয়, সে জন্য সংসদেও কথা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সরকার তাদের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে একটি মহৎ ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন স্কুলের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ নিবন্ধন পরীক্ষার নম্বরের ভিত্তিতেই হয়ে থাকে।

ফলে যারা প্রকৃত মেধাবী তারাই শিক্ষকতায় আসার সুযোগ পাচ্ছেন। এ সিদ্ধান্তের ফলে শিক্ষার্থী ও রাষ্ট্র দুই-ই উপকৃত হচ্ছে। প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজের সব নিয়োগের বিষয় যদি সরকার কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই স্কুল-কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে প্রবেশের আগ্রহ তাদের কমে যাবে। 

এবার নিশ্চয় এ গোষ্ঠীর সদস্যগুলো সরকারের ওপর আরও বেশি বিরক্ত হবে। কেননা, সরকার স্কুল-কলেজের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য হওয়ার জন্য নূ্যনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছে। আমরা চাই, এ বিষয়টি অতি দ্রুত বাস্তবায়ন হোক। আগে যেমন সরকার তাদের কথায় গুরুত্ব দেয়নি; এবারও দেবে না বলে আমরা বিশ্বাস করি। আমাদের সন্তানদের আমরা অশিক্ষিতদের ব্যবস্থাপনায় শিক্ষিত করতে চাই না।

শিক্ষিত হওয়ার পশাপাশি অন্যান্য বিষয়ের প্রতিও সরকারের নজর দেওয়া প্রয়োজন। কেননা, শহরের ভালো স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করতে আমাদের অসৎ অভিভাবকরা লাখ লাখ টাকার বিনিময় করে স্কুলের অসৎ ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের সঙ্গে। বিষয়টি নিশ্চয় আমাদের কারও অজানা নয়। 

এই বিষয়গুলোর প্রতিও নজরদারি  বাড়ানো প্রয়োজন। 

নিজ থেকে দেখেছি, স্কুল কমিটির সভাপতিসহ অন্যরা কত নীচু পর্যায়ে নামতে পারে! একই সঙ্গে কিছু মহৎ হৃদয়ের সভাপতিকেও দেখেছি, কিন্তু সেটা হাতেগোনা। বর্তমানে গ্রামের স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদ বিক্রি হচ্ছে ১০-১৫ লাখ টাকায়। শহরে সেটা আরও বেশি। আর কর্মচারীর পদ বিক্রি হচ্ছে ৫ থেকে ৮ লাখ টাকায়। টাকা না দেওয়া হলে স্কুল কমিটির সভাপতির রাজনৈতিক গুরু বলে দিলেও চাকরি হয় না।

এও দেখেছি, আওয়ামী লীগের শীর্ষ পদের নেতা সুপারিশ করার পরও কর্মচারী পদে চাকরি হয়নি। কেননা, সে সভাপতিকে টাকা দেয়নি। এটি শুনে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাও তার কর্মীর কাছে অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছেন। আমার দুর্ভাগ্য, এমন কয়েকটি ঘটনার কথা আমি শুনেছি এবং বাস্তবে তার প্রমাণও পেয়েছি। এসব কারণেই হয়তো আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নৈশ প্রহরী নিয়োগ দিয়ে যারা টাকা নেয়, তেমন নেতার প্রয়োজন নেই তাদের। 

স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটি স্কুলের সম্পদকে নিজের অর্জিত হালাল সম্পদ বলে মনে করে। তাই যখন যেভাবে ইচ্ছা ব্যক্তিগত কাজে খরচ করে। কেউ বাধা দিলে তাকে আবু হানিফের মতো পরিণতি বরণ করতে হয়। 

সরকারের বড় বড় অর্জনে আমরা তরুণরা সাহস পাই, সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি পাই। যখন দেখি আমাদের শিক্ষাগুরুদের সঙ্গে এমনটি করা হচ্ছে, তখন মেনে নিতে পারি না। এগুলোর বিচার না হলে সহ্য করতে পারি না। তাই তো নারায়ণগঞ্জের ঘটনার পর সারাদেশের শিক্ষক-শিক্ষার্থী কান ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এমন কিছু ঘটনা সরকারের বড় বড় সাফল্য ম্লান করে দেয়। 

মাননীয় শিক্ষা উপমন্ত্রীর বক্তব্যে আমরা আশাবাদী। প্রত্যাশা করি, সরকার দ্রুতই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। আমরা চাই, আমাদের সন্তান কোনো অশিক্ষিত ও অসৎ মানুষের ব্যবস্থাপনায় নয়; বরং শিক্ষিত ও ভালো মানুষের ব্যবস্থাপনায় বড় হোক। 

লেখক: প্রভাষক গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: সমকাল

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0049598217010498